আজিজুল হক
সভ্যতার ইতিহাস খনন করার নেশায় যিনি নিজেই একটি প্রামানিক লাইব্রেরী বলে কথিত, যাঁর গবেষণাধর্মী লেখা দৈনন্দিন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় চোখে পড়ে, তিনি হলেন জনপ্রিয় প্রাবন্ধিক ও ইতিহাস গবেষক জনাব আমিনুল ইসলাম। টগবগে তারুণ্যদীপ্ত আমিনুল ইসলাম পেশায় একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। হলদিয়া ডিগ্রী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অন্যতম আধিকারিক। পাকাপাকিভাবে থাকেন নিজের গ্রামেই। গ্রামের নাম ঢেকুয়া। এটি হুগলি নদীর তীর থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরত্বের পথ। মেদিনীপুর জেলার সুতাহাটা থানার কয়েকশো বছরের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম ঢেকুয়া।
সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের এই নীরব সাধকের সাথে আলাপচারিতা সেই সঙ্গে তাঁর সংগৃহীত দেশে-বিদেশের বেশ কয়েক হাজার দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থাবলী দু'চোখে দেখার কৌতুহল ছিল দীর্ঘদিন। তাঁর মতো একজন গুণবান মানুষের আহ্বানে গত ১০ জুলাই ২০২১ রবিবার রওনা দিই মেদিনীপুরের পথে। লঞ্চ যোগে ডায়মন্ডহারবার থেকে হুগলি নদীর কল কল ঢেউয়ের মাথায় দুলতে দুলতে প্রায় ৩৫ মিনিটে নদী পেরিয়ে পৌঁছুলাম কুকড়াহাটিতে। ওখান থেকে টোটো যোগে প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ চলার পর এলাম ঢেকুয়ায়।
আমাদের জন্য যাত্রা পথেই সাগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন অতিথি পরায়ণ জনাব আমিনুল ইসলাম।পথের ধারে একটা চায়ের দোকানে বসে চা পানের পর টোটো যোগে রওনা দিলাম তাঁর বাড়ির দিকে। চলার পথে শোনালেন তাঁর গ্রামের কথা। ঝাঁ-চকচক গ্রামের রাস্তার দু'পাশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মক্তব, খানকা, ঈদগা। সেইসব শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের স্মৃতি ও প্রীতি ছোঁয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ফুরফুরা ও পিয়ারডাঙা শরীফ-এর অলিয়ে কামেলদের স্মৃতি।
আমিনুলের সংগৃহীত গ্রন্থাবলী থেকে কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস জানা যায়।
।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।
সবুজ গাছগাছালির ছায়া সুনিবিড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শোভায় ভরপুর আমিনুল ইসলামের বাড়ি। দ্বিতল বাড়ির অন্দরের প্রবেশ পথেই নজরকাড়া লাইব্রেরী। বইয়ের নানান সেলফ-এ রয়েছে দেশ-বিদেশের বই আর বই। তিনি বুঝেছেন বইয়ের বিকল্প হয় না। সত্য সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় আলোকিত পথ দেখায় বই। কেবল ব্যক্তিকে নয়, সমাজ থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আলোর ভুবন গড়ার পথ দেখায় বই। তাঁর সাক্ষাতে যত মানুষ আসেন প্রথমে এই লাইব্রেরীতে এসে ঘাম জুড়িয়ে নেন। অতঃপর চলে প্রয়োজনীয় কথা। দেশ-বিদেশের নানান দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থাবলী দেখে স্তম্ভিত হলাম। নানান রকম গ্রন্থাবলীর নাম ও লেখক এর নাম দেখে বারে বারে চোখ হয়ে উঠল জ্বলজ্বলে। ওই রকম নানান রকমারি বই সংগ্রহের জন্য আমার অন্তরে থেকে গেল চাতকের মত অনন্ত পিপাসা।
বিদগ্ধ আলেম পরিবারে জন্ম আমিনুলের
।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।
আমিনুল সাহেবের সংগৃহীত বইয়ের লাইব্রেরীতে রয়েছে নানান প্রকৃতির বই। সেই সঙ্গে রয়েছে মহার্ঘ ইসলামি বই। তাঁর সঙ্গে কয়েক ঘন্টা কাটানোর ফাঁকে ফাঁকে তিনি ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর অসাধারণ আলোচনা করলেন। একজন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ হয়েও ইসলামিক ফেকা, তাফসীর, আকিদা, মসলা, মাসায়েলসহ অজস্র বইয়ের নাম ও তার লেখকের নামসহ উদ্বৃতি আমাকে ভাবায়। শুধু তাই নয়, আল্-কোরআন মাজিদের আরবি আয়াত, তরজমা ও উদ্ধৃতি শ্রবণে আরো বিস্ময়াবিষ্ট হলাম। কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম, এত চর্চা কিভাবে করলেন? তিনি জানালেন, শৈশব থেকে তাঁর পারিবারিক পরিবেশেই চর্চা। সেই ধারাবাহিকতা থেকে গেছে পরবর্তী সময়েও। তাঁর পিতা ছিলেন একজন বিদগ্ধ আলেম। সমাজ-ভাবনার মানুষ।
পিতার ৪ সন্তানের কমবেশি সবাই প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা হলেন বজলুল করিম, রুহুল আমিন, নুরুল হুদা ও আমিনুল ইসলাম। সবার বড় হলেন বজলুল করিম। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে তাঁর পড়াশোনা। কর্মজীবনে তিনি স্থানীয় একটা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। অবসর জীবনে তিনি আমিনুল সাহেবের লাইব্রেরীতে জ্ঞান সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন রাখেন। আলাপচারিতায় তাঁর পাণ্ডিত্য অনুভব করলাম।
আমিনুল ইসলাম লেখালেখির মধ্যে দিয়ে দিনরাত ডুবে থাকলেও তাঁর দুই ছেলেমেয়ের কেরিয়ার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি সবিশেষ যত্নবান। ছেলে মোহাম্মদ সাহিল, ইঞ্জিনিয়ার। মেয়ে কানিজ মোস্তফা গত বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেদিনীপুর জেলায় প্রথম স্থান অর্জন করে। বর্তমানে বিজ্ঞান নিয়ে পাঠরত।
গাঁয়ের আর একজন গুণী লেখক এস এম আখতার হোসেন সম্পর্কে দু'চার কথা
।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।
একটা সময়ে সমাজ ভাবনার অনেক গুণী মানুষ জন্মেছিলেন ঢেকুয়া গ্রামে। সাহিত্য ইতিহাস চর্চা ও লেখনীর মধ্যে দিয়ে পরিচিত হয়ে উঠেছেন বাংলার জনমানসে। তাঁদের মধ্যে আরো একজন হলেন মরহুম আলহাজ্ব এস এম আখতার হোসেন। চিরন্তন ঐতিহ্য ভাবনার মানুষটি কয়েক মাস আগে পরজগতে পাড়ি জমিয়েছেন। মহানগরী কলকাতার বুকে কলেজ স্ট্রিটে তিনি গড়ে তোলেন দুটি প্রকাশনা সংস্থা। সংস্থা দুটির নাম, বাণী প্রকাশ ও লিপি সংসদ। সেই প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর নিজের অনুদিত ও সম্পাদিত ১৬৩২ পৃষ্ঠার দু'খন্ড 'আল্ কুরআনুল হাকীম।' এছাড়া তাঁর অনুবাদ ও সম্পাদনায় আরো দুটি গ্রন্থ, 'পবিত্র কুরআন শরীফ' ও 'কুরানুল কারীম' তিনি প্রকাশ করেন। এছাড়াও তিনি রচনা করেন হজ্ব বিষয়ক একটি অমূল্য গ্রন্থ।
লেখক চিরন্তন ভাবনায় সমৃদ্ধ হয়ে বিভিন্ন সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। বইয়ের ব্যবসাটাকে সমৃদ্ধ করতে তিনি স্কুল, মাদ্রাসার ছাত্র ছাত্রীদের জন্য অজস্র পাঠ্যপুস্তকও প্রকাশ করেছিলেন।
আজীবন তিনি ছিলেন সমাজ গড়ার উন্নত চেতনাসমৃদ্ধ মানুষ। দ্বীনি শিক্ষা প্রসারে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিজস্ব গ্রামের 'শতবর্ষের ঢেকুয়া বার্ষিক ইসালে সওয়াল' কমিটির মুখ্য উপদেষ্টা ছিলেন।
তাঁর সমাজ ভাবনা একরকম পারিবারিক ধারাবাহিকতা। এস এম আখতার হোসেনের দাদু জান সাইদুর রহমান ওরফে 'মিয়া সাহেব' ছিলেন সমাজ গড়ার মানুষ। ঢেকুয়া গ্রামকে কুসংস্কার মুক্ত করতে গ্রাম সংশোধনের কাজের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। তৎকালীন সময়ে গ্রামে স্বাস্থ্যপরিসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি স্থানীয় আর এক গুণী ব্যক্তিত্ব হাজী আজিজার রহমানের সঙ্গে সহযোদ্ধা হয়ে গড়ে তোলেন 'ওজিরিয়া চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি।'এছাড়া সরকারি উদ্যোগে গ্রামের পূর্বপ্রান্তে কাটা হয় এক বড় দীঘি।
কেমন ছিল ঢেকুয়া গ্ৰাম
।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।
পূর্ব মেদিনীপুরের সুতাহাটা থানার ঢেকুয়া আদর্শ গ্রামের রূপ নিয়েছে। একটা সময় ছিল শিক্ষা-দিক্ষাহীন। অপসংস্কৃতির করাল গ্রাসে আচ্ছন্ন। স্থানীয় ঢেকুয়া ফারুকিয়া হাই মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষক মোহাম্মদ বজলুল করিম জানান, শোনা যায় একদিন ১০১ টি হুঁকো ভাঙ্গা হয়েছিল। এ অঞ্চলের তাজিয়া খেলার চল খুবই প্রচলিত ছিল। ঢেকুয়ার তাজিয়া ছিল সুতাহাটা থানার বিখ্যাত তাজিয়া।
পীর ও মাশায়েখদের মেহনতে হয়ে উঠল আদর্শ গ্রাম
।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।
গোমরাহী থেকে মুক্ত করে ইসলাম নিষ্ঠ্য করে গড়ে তুলতে বিভিন্ন এলাকার আলেম ওলামাদের বিশেষ উদ্যোগ দেখা যায়। ঢেকুয়া ফারুকিয়া হাই মাদ্রাসার সাবেক প্রধান শিক্ষক মাওলানা মোঃ ইয়াকুব আলী জানান, গ্রামের ঐতিহ্য ও সুচেতনা বিকাশে মাওলানা আব্দুল মাবুদ ফারুকীর (রহ:) বিশেষ অবদান রয়েছে। ফারুকী সাহেবের বাড়ি অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনা থানার পিয়ারডাঙ্গা গ্রামে।
0 Comments