আনসারুল আব্বাস
“তিনিই মহান সত্তা যিনি ভূমিকে তোমাদের অধীন করে বানিয়েছেন, তোমরা (যেভাবে চাও) এর অলিগলির মধ্য দিয়ে চলাচল করো এবং এর থেকে (উদগত) রেযেক তোমরা উপভোগ করো, (অবশেষে) তাঁর দিকেই (হবে সবাই) প্রত্যাবর্তন”
[সূরা আল-মুলকঃ ১৫]
মুসলিম মাত্রই আমরা বিশ্বাস করি রিজিকের মালিক হলে মহান আল্লাহ তাওয়াল।আমরা রিজিক বৃদ্ধি করতে সদা সচেষ্ট থাকি। আমরা প্রত্যেকেই চায় আমাদের রিজিক বৃদ্ধি হোক। কিন্তু যে মহান স্রষ্টা রিজিক বৃদ্ধি করতে পারে আমরা সেই মহান স্রষ্ঠা আল্লাহ তাওয়ালা কেই ভুলে যায়। মহান আল্লাহ তাওয়ালা রিজিক বৃদ্ধির উপায় কুরআনে ও নবীর মাধ্যমে হাদীসে জানিয়ে দিয়েছেন।
আমরা তা একে একে আলোচনা করবো
প্রথম আমল- তাকওয়া ও তাওয়াক্কুল
অবলম্বন করা
_আল্লাহর ভয় তথা তাক্বওয়া অবলম্বন করা,
অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশাবলী পালন করা
এবং হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়গুলো বর্জন করা।
পাশাপাশি আল্লাহর ওপর অটল আস্থা রাখা,
তাওয়াক্কুল করা এবং রিজিক তালাশে আল্লাহর
সাহায্য প্রার্থনা করা। কারণ, যে আল্লাহর
ওপর ভরসা করে তিনিই তার জন্য যথেষ্ট
হয়ে যান।
আল্লাহ তাআ’লা ইরশাদ করেন-
.
“আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে,
তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী
করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস
থেকে রিযিক দিবেন, যা সে কল্পনাও
করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর
ওপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) করে আল্লাহ তার
জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য
পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয় আল্লাহ
প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি
সময়সীমা নির্ধারণ করে
দিয়েছেন।” [সূরা আত-তালাকঃ ২-৩]
:
:
সুতরাং, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয়
করবে এবং তাঁর আনুগত্য করবে, আল্লাহ
তার সকল সংকট দূর করে দেবেন এবং
তার কল্পনাতীত স্থান থেকে
রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। আর
যে কেউ তার উদ্দেশ্য হাসিলে
একমাত্র আল্লাহর শরণাপন্ন হয়, তিনিই তারজন্য যথেষ্ট হয়ে যান। বলাবাহুল্য এই
তাকওয়ার পরিচয় মেলে হালাল
উপার্জনের চেষ্টা এবং সন্দেহযুক্ত
উপার্জন বর্জনের মধ্য দিয়ে।
:
দ্বিতীয় আমল- তাওবা ও ইস্তেগফার
করা
_
অধিক পরিমাণে ইস্তেগফার এবং বেশি
বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা
করলেও রিজিক বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তাআ’লা
তাঁর অন্যতম নবী ও রাসুল নূহ আ’লাইহিস
সালামের ঘটনা তুলে ধরে ইরশাদ
করেন,
.
“আর আমি (নূহকে) বলেছি, তোমরা
তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও;
নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল। (তাঁর কাছে
ক্ষমা চাইলে) তিনি তোমাদের উপর
মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, আর
তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-
সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন এবং
তোমাদের জন্য বাগ-বাগিচা দেবেন
আর দেবেন নদী-নালা।” [সূরা নূহঃ
১০-১২]
একটি হাদীসে বিষয়টি আরেকটু
খোলাসা করে বলা হয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু
আ’নহুমা কর্তৃক বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেছেন-
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু
থেকে বর্ণিত,
রাসুলুল্লাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া
সাল্লাম) বলেছেন-
.
“যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তেগফার
করবে, আল্লাহ তার সব সংকট থেকে
উত্তরণের পথ বের করে দেবেন,
সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং
অকল্পনীয় উৎস থেকে তার
রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন।”
.
[বায়হাকীঃ ৬৩৬, হাকেম, মুস্তাদরাকঃ
৭৬৭৭ সহীহ সূত্রে বর্ণিত]
তৃতীয় আমল ঃ দান-সদকা:
আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা
_
আল্লাহর রাস্তায় কেউ ব্যয় বা দান করলে
তা বিফলে যায় না। সে সম্পদ ফুরায়ও না।বরং তা বৃদ্ধি পায়।
:
আল্লাহ তাআ’লা ইরশাদ করেছেন-
.“(হে নবী!) আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার
রব তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা
রিযক প্রশস্ত করেন এবং সঙ্কুচিত
করেন। আর তোমরা যা কিছু আল্লাহর
জন্য ব্যয় কর তিনি তার বিনিময় দেবেন
এবং তিনিই উত্তম রিযকদাতা।” [সূরা আস-সাবাঃ
৩৯]
"কে আছে, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেবে, ফলে তিনি তার জন্য বহু গুণে বাড়িয়ে দেবেন? [সূরা বাক্বারাহ(২): ২৪৫]
চতুর্থ আমল ঃ কৃতজ্ঞতা বা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করাঃ
আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেবো, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন’। [সূরা ইবরাহিম(১৪): ৭]
..🌸🌸💐💐
পঞ্চম আমল ঃ আত্মীয়দের
সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা
_
আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায়
রাখা এবং তাদের হক আদায়ের মাধ্যমেও
রিজিক বাড়ে। যেমন-
.
আনাস ইবন মালেক রাদিআল্লাহু আ’নহু
থেকে বর্ণিত,
আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া
সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি ইরশাদ
করেছেন-
.
“যে ব্যক্তি কামনা করে যে, তার রিজিক
প্রশস্ত করে দেওয়া হোক এবং তার
আয়ু দীর্ঘ করা হোক, তাহলে সে
যেন তার আত্মীয়দের সঙ্গে
সুসম্পর্ক বজায় রাখে।”
.
[বুখারীঃ ৫৯৮৫, মুসলিমঃ ৪৬৩৯]
:.🌸🌸💐💐
ষষ্ঠ আমল ঃ নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি
ওয়া সাল্লামের ওপর দরূদ পড়া
_
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া
সাল্লামের প্রতি দরূদ পাঠেও রিজিকে
প্রশস্ততা আসে। যেমনটি অনুমিত হয়
নিম্নোক্ত হাদীস থেকে।
তোফায়েল ইবন উবাই ইবন কা’ব
রাদিআল্লাহু আ’নহু কর্তৃক বর্ণিত, তিনি
বলেন-
.
আমি জিজ্ঞেস করলাম- হে আল্লাহর
রাসুল, আমি আপনার প্রতি অধিকহারে দরূদ
পড়তে চাই, অতএব আমার দুয়ার মধ্যে
আপনার দরূদের জন্য কতটুকু অংশ রাখব?
.
তিনি (সাঃ) বললেন- তুমি যতটুকু চাও।
কা’ব বলেন- আমি বললাম, এক চতুর্থাংশ।
তিনি (সাঃ) বললেন- তুমি যতটুকু চাও। তবে
কা’ব বলেন- আমি বললাম, এক চতুর্থাংশ।
তিনি (সাঃ) বললেন- তুমি যতটুকু চাও। তবে
যদি তুমি আরো বেশি দরুদ পড়, তা
তোমার জন্য উত্তম হবে।
আমি বললাম- অর্ধেক?
.
তিনি (সাঃ) বললেন- তুমি যতটুকু চাও। তবে
তুমি যদি আরো বেশি পড়, তা তোমার
জন্য উত্তম হবে।
কা’ব বলেন- আমি বললাম, তাহলে দুই
তৃতীয়াংশ?
তিনি (সাঃ) বললেন- তুমি যতটুকু চাও। তবে
তুমি যদি বেশি পড় তা তোমার জন্য
উত্তম হবে।
.
আমি বললাম- আমার দুয়ার পুরোটা
জুড়েই শুধু আপনার দরূদ রাখব।
তিনি (সাঃ) বললেন- তাহলে তা তোমার
ঝামেলা ও প্রয়োজনের জন্য
যথেষ্ট হবে এবং তোমার গুনাহ ক্ষমা
করা হবে।
[তিরমিযীঃ ২৬৪৫, হাকেম, মুস্তাদরাকঃ
৭৬৭৭। ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীসটি
‘হাসান সহীহ’]
-সপ্তম আমলঃ দুর্বলের প্রতি সদয় হওয়া
বা সদাচার করা
_
মুসআ’ব ইবন সা’দ রাদিআল্লাহু আ’নহু
একবার যুদ্ধ জয়ের পর মনে মনে
কল্পনা করলেন- তিনি বোধ হয় তাঁর
বীরত্ব ও শৌর্য-বীর্য হেতু
অন্যদের চেয়ে নিজেকে বেশি
মর্যাদাবান।
.
সেই প্রেক্ষিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন-
“তোমাদের মধ্যে থাকা দুর্বলদের
কারণে কেবল তোমাদের সাহায্য করা
হয় এবং রিজিক প্রদান করা হয়।” [সহীহ
বুখারীঃ২৮৯৬]।
হালাল রিযিকের জন্য প্রচেষ্টা চালানোঃ
রিযিক বৃদ্ধির জন্য প্রচেষ্টা ও চালাতে হবে
মহান আল্লাহর ঘোষণা
"অতঃপর যখন (জুমার) নামাজ শেষ হয়ে যাবে তখন তােমরা (কাজেকর্মে) পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়াে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করাে, আর আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করাে, আশা করা যায় তােমরা সাফল্য লাভ করতে পারবে।"
(সূরা জুমার ১০)
*হালাল রিযিক অনুসন্ধানও আল্লাহর এবাদাত : ‘তারপর নামায শেষ হয়ে গেলে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ে এবং আল্লাহর রহমত তালাশ করাে।' এরপর আয়াতটি আল্লাহর স্মরণের সাথে সাথে মানুষের জীবিকা অর্জনের উপায় উপকরণের দিকে ফিরে এসে আমাদের জানাচ্ছে, নামায সমাপ্ত হলে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ো, আল্লাহর রহমত তালাশ করাে এবং বেশী বেশী করে আল্লাহকে স্মরণ করো, হয়ত এভাবেই তােমরা সাফল্যমন্ডিত হবে। এ ভারসাম্য হচ্ছে জীবনের প্রয়ােজনে, কাজ, পরিশ্রম, প্রচেষ্টা ও উপার্জন এবং মাঝে মাঝে এসব কিছু থেকে মানুষের আত্মা-মনকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে আল্লাহর স্মরণ ও মহব্বতে নিমগ্ন করে দেয়া। অন্তর ও আত্মাকে জীবিত রাখার জন্যে এই পদ্ধতি অত্যন্ত জরুরী। এ পদ্ধতি ব্যতীত আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং তার দেয়া আমানতের বােঝা বহন করা সম্ভব নয়। রােযগারের জন্যে চেষ্টা করার কালে আল্লাহ তায়ালার স্মরণ অতীব জরুরী। এই স্মরণের কারণেই যা কিছু কাজকর্ম করা হয় এজাহেলিয়াতের যমানায় ধন দৌলতের তালাশে মানুষ যেসব প্রচেষ্টা চালাতাে, তার মধ্যে থাকতাে না কোনাে নীতি নৈতিকতা, মানবতাবােধ বা কারও কাছে কোনাে জওয়াবদিহিতার মন মানসিকতা। সেই সমাজ থেকে বের করে নিয়ে আসা এই ক্ষুদ্র মানবগােষ্ঠীকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও তাঁর কাছে জওয়াবদিহিতার মানসিকতা দান করে তাদের তিনি সােনার মানুষরূপে গড়ে তুলেছেন, যারা সামাজিক জীবনের মৌলিক উপাদানে সমৃদ্ধ হয়ে গােটা সমাজকে সুখ শান্তি, সমৃদ্ধি, পারস্পরিক বিশ্বাস ও মহব্বতের আমেজে ভরে আয় রােযগারের যে চেষ্টা চালানাে হয়, তা সব কিছুই এবাদাতে পরিণত হয়ে যায়। এ স্মরণ সর্বক্ষণ তো থাকতেই হবে, তবু বিশেষভাবে কিছু সময় নিছক আল্লাহর জন্যে বের করে নেয়া এবং একান্তভাবে আল্লাহর জন্যে নিজেকে নিবেদিত করে দেয়ার জন্যেই এ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইরাক ইবনে মালেক(রা.) জুমার নামায শেষ করে যখন বের হতেন, তখন তিনি এসে মসজিদের দরজায় দাড়িয়ে বলতেন, হে আল্লাহ, আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি, আপনার নির্দেশমতাে (ফরয) নামায আদায় করেছি এবং আপনার নির্দেশ মতােই আমি রুজির তালাশে বেরিয়ে পড়েছি। অতএব, আপনার মেহেরবানী দ্বারাই আমার রুজির ব্যবস্থা করে দিন। অবশ্যই আপনি সর্বোত্তম রিযিকদানকারী (ইবনে হাতেম হাদীসটি রেওয়ায়াত করেন)। রুযি রােযগারের তালাশে কিভাবে বেরুতে হবে, তা উক্ত হাদীস সে চিত্রটি আমাদের কাছে অতি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে। আল্লাহর হুকুম কি ভাবে পালন করতে হবে, তা বুঝার জন্যে একথাগুলাে শােনার পর আমাদের মধ্যে আর কোনাে প্রকার অস্পষ্টতা থাকে না, থাকে না এ কথাগুলাের তাৎপর্য বুঝতে কোনাে সংকট।
0 Comments