**ইবনে খালদুন ও পাশ্চাত্য আধুনিক চিন্তাবিদ**
পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের সাথে ইবনে খালদুনের মতাদর্শের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে তাদের চিন্তায়। অন্যান্য মুসলিম চিন্তাবিদদের মতোই ইবনে খালদুনের দর্শনের তিনটি স্তর ছিল যথা ১. দৃশ্যমান ও বস্তু কেন্দ্রিক জগৎ, ২. অদৃশ্যমান ও অবস্তু কেন্দ্রিক জগৎ, ৩. Divine world.
ইবনে খালদুনের বহুমাত্রিক জ্ঞানতত্ত্ব যুক্তি, চেতনা, স্বর্গীয় বাণী এবং আধ্যাতিক উন্মোচনের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেটা ইবনে খালদুনকে অন্যান্য আধুনিক চিন্তাবিদদের এক মাত্রিক দৃশ্যমান ও বস্তু কেন্দ্রিক জ্ঞানতত্ত্ব থেকে পৃথক করে।
ইবনে খালদুনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তার পদ্ধতিগত চিন্তা ভাবনায় স্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে যেটা তার উত্তরসূরিদের থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। খালদুন ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষক ছিলেন। একজন দার্শনিক হিসেবে ইতিহাসের অভ্যন্তরীণ তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিতে তিনি পারদর্শী ছিলেন, এর সাথে সাথে সমাজ বিজ্ঞানী হিসাবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
ইবনে খালদুন তার লেখা আল মুকাদ্দিমা গ্রন্থে সর্ব প্রথম ইতিহাস চর্চাকে একটা আলাদা বিষয় রূপে তুলে ধরেছেন।
দ্বিতীয়ত তিনি মনে করতেন ইতিহাসের সামাজিক প্রেক্ষাপট কখনোই চিরস্থায়ী নয় বরং সেটা পরিবর্তনশীল এবং চলমান। খালদুন সবসময় যুক্তি এবং প্রমাণের সাপেক্ষে কোনো ঘটনার উপসংহারে পৌঁছানোর পক্ষে জোর দিতেন যেটা যুক্তিবাদীদের ফ্যাক্ট থেকে ফিকশন আলাদা করার সহায়তা করে।
ইতিহাসের গভীর পর্যবেক্ষণ থেকে এটাও প্রমাণিত হয় যে ইবনে খালদুনই প্রথম ব্যক্তি যিনি ফ্রী মার্কেট ইকোনমির ওপর লিখেছেন এবং ভ্যালু অব লেবার থিওরি এর ধারণা দিয়েছেন যেটা কার্ল মার্কস ৭০০ বছর পরে একই ধরনের তত্ত্ব নিয়ে হাজির হন।
খালদুনের ভ্যালু অব লেবার থিওরি পরে ডেভিড হিউমের রাজনৈতিক আলোচনায় সংগৃহীত হয় যেটা ১৭৫২ সালে প্রকাশিত হয়।
অধিকন্তু ইবনে খালদূনই সর্ব প্রথম অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের সাধনী হিসেবে চাহিদা, সরবরাহ, মূল্য এবং লাভের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন। খালদুন অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ব্যাখ্যার স্বরূপ দিতে গিয়ে বিভিন্ন শহরের এবং সেখানকার লোকেদের জীবিকা, পেশা, ব্যাবসা এবং উৎপাদনের একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। সেই মোতাবেক ইবনে খালদুনকে আধুনিক অর্থনীতি বিদ্যার জনক হিসেবেও ধরা যেতে পারে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাকে বিভিন্ন পাশ্চাত্য চিন্তাবিদরা সর্বোপরি এড়িয়ে চলেছেন এমনকি বিভিন্ন ধারণা তারা খালদুনের কাছ থেকে নিলেও সেগুলো নিজেদের বলে প্রচার করেছেন।
অর্থনীতির সাথে সাথে তিনি সমানভাবে রাজ্য, রাজত্ব এবং রাজনীতি বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা গুলোকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ এবং সমাধানের পথও দিয়ে গেছেন। সেইদিক দিয়ে তাকে আধুনিক রাজনৈতিক দর্শনের স্রষ্টা হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
Macroeconomics এর প্রসঙ্গ এলেও ইবনে খালদুন "Agreegate effective demand" তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন। তার অনুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে যখন চাহিদা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় তখন উৎপাদন, লাভ এবং খাজনাও বেড়ে যায়।
Adam Smith এর অনেক আগেই ইবনে খালদুন free economy এবং freedom of choice এর বিষয়টি উত্থাপন করেছেন তা সত্বেও Adam Smith কে আধুনিক অর্থনীতির জনক হিসেবে ধরা হয় যেটা পাশ্চাত্য সভ্যতার মতাদর্শিক আগ্রাসন ছাড়া আর কিছুই না।
বর্তমানে ইবনে খালদুণের প্রকৃত অনুসারীদের উচিত তাকে অগভীরভাবে পড়াশুনা না করে তার বহুমাত্রিক তত্ত্ববিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব এবং প্রণালী বিদ্যার ওপর জোর দিয়ে তাকে ইউরোকেন্দ্রিক সমাজ বিজ্ঞানের একটা বিকল্প রূপে তুলে ধরা।
১৪০৬ সালের ১৭ ই মার্চ এই মহান চিন্তাবিদ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মিশরের রাজধানী কায়রোতে Bab an-nasr এর বাইরে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
0 Comments