[পর্ব-০৩]
~~ ড. আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল
ভারতীয় জাতির ঐক্য
তা হলে আমাদের সমস্যা কি এবং তার তাৎপর্যই বা কি? ধর্ম কি একটি ঘরোয়া ব্যাপার মাত্র? আপনারা কি দেখতে চান যে, ইতিপূর্বে ইউরোপে খৃষ্টধর্ম যে পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে, ইসলামী বিশ্বেও নৈতিক ও রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে ইসলাম সেই একই পরিণতি লাভ করুক? ধর্মীয় মনোভাব কোনো ভূমিকা পালন করবে না এমন ধরনের জাতীয় শাসনব্যবস্থা চালু করার জন্য ইসলামের শাসনব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করে দিয়ে নৈতিক আদর্শ হিসাবে ইসলামকে বাঁচিয়ে রাখা কি সম্ভব? ভারতে যেখানে মুসলিম জনগণ সংখ্যালঘু হয়ে আসছে, সেখানে এ প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম যে একটি ঘরোয়া ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, এ মতবাদ কোনো ইউরোপীয়দের মুখে বিস্ময়কর নয়। ইউরোপ একটি যৌক্তিক চিন্তাধারার পথ ধরে এই মতবাদের দিকে ধাবিত হয়। সন্যাসবাদী ধারা হিসাবে খৃষ্টধর্ম বস্তুজগতকে অস্বীকার করে এবং আত্মিক জগতের দিকে তার পূর্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে যার ফলশ্রুতিতে ইউরোপ এই মতবাদ অনুসরণ করে। রাসূল (সা) এর যে ধর্মীয় অভিজ্ঞতা কুর'আন শরীফে বর্ণিত হয়েছে, তার প্রকৃতি অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিছক জীবতাত্ত্বিক ঘটনা বলতে আমরা যা বুঝি, এ কেবল সেই ধরনের অভিজ্ঞতা নয়- যা অভিজ্ঞতালাভকারীর নিজের ভিতর ঘটে এবং সামাজিক, পারিপার্শ্বিকতার উপর যার কোনো প্রতিক্রিয়া অপরিহার্য নয়। এ হচ্ছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যা সামাজিক কাঠামোর জন্ম দেয়। এর অব্যবহিত পরিণাম হচ্ছে একটি বিশেষ রাষ্ট্রশাসন-ব্যবস্থার বুনিয়াদ সৃষ্টি যার মধ্যে আইনগত ধারণাসমূহ প্রচ্ছন্নভাবে নিহিত রয়েছে এবং এর উৎস কেবল ওহী বলেই তার সামাজিক গুরুত্বকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
সুতরাং ইসলামের ধর্মীয় আদর্শ মৌলিক দিক থেকেই তার সৃষ্ট সামাজিক কাঠামোর সাথে সম্পর্কযুক্ত। একটিকে অগ্রাহ্য করলে পরিণামে অপরটিকেও অগ্রাহ্য করতে হয়। সুতরাং জাতীয় ধারাসম্বলিত বিশেষ রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা (polity on national lines) গড়ে তুলতে গেলে যদি তার অর্থ হয় ইসলামী সংহতির নীতিকে বিপর্যস্ত করা, যেকোনো মুসলিম সে ধরনের ব্যবস্থা অবলম্বনের কথা চিন্তাও করতে পারে না। এই সমস্যাই আজকের দিনের ভারতীয় মুসলিম জনগণের সামনে প্রত্যক্ষভাবে ধরা দিচ্ছে। রেনান বলেন: “Man is enslaved neither by his race, nor by his religion, nor by the course of rivers, nor by the direction of mountain ranges. A great aggregation of men, sane of mind and warm of heart, creates a moral consciousness which is called a nation.” – “মানুষ তার বর্ণ, তার ধর্ম, নদীসমূহের স্রোত অথবা পর্বতমালার দিকনির্দেশনার দাস হয়ে থাকে না। এক বিরাট মানবসমষ্টি মানসিক স্থিরতা ও অন্তরের উষ্ণতা সহকারে যে নৈতিক চেতনা সৃষ্টি করে, তাঁরই নাম জাতি”। এমনভাবে সংগঠিত করা বেশ সম্ভব যদিও এর জন্য প্রায়গিক অর্থেই নতুন করে মানুষ বিনির্মাণের কঠিন এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়া জড়িত এবং একইসাথে নতুন উন্মাদনার আঞ্জাম দেওয়া জরুরী। কবীরের শিক্ষা ও আকবরের ধর্মবিশ্বাস দেশের জনগণের কল্পনা আকৃষ্ট করলে ভারতে এ সম্ভাবনা সত্যে পরিণত হত। অভিজ্ঞতায় অবশ্য দেখা যায় যে, ভারতের বিভিন্ন জাত ও ধর্মীয় দলের মধ্যে তাদের নিজ নিজ স্বতন্ত্র সত্তাকে এক বৃহত্তর সামগ্র্যে বিলীন করে দেবার কোনো প্রবণতার আভাস পাওয়া যায় না। প্রত্যেক দল তার সমষ্টিগত অস্তিত্ব সম্পর্কে তীব্রভাবে সচেতন। রেনানের ধারণা অনুযায়ী জাতির উপাদান সন্নিবেশ করার মতো নৈতিক চেতনা গড়ে তোলার জন্য যে মূল্য দেবার প্রয়োজন, ভারতের জাতিসমূহ সে মূল্য দিতে প্রস্তুত নয়।
সুতরাং এক ভারতীয় জাতির ঐক্য খুঁজতে হবে বহুকে অস্বীকার করার ভিতরে নয়, বরং বহুর পারস্পরিক ঐক্য ও সহযোগিতার ভিতরে। সত্যিকার রাজনীতিজ্ঞান সত্যকে অস্বীকার করতে পারে না, তা যতোই পীড়াদায়ক হোক। যেরূপ পরিস্থিতির অস্তিত্ব নেই, তার অস্তিত্ব কল্পনা করাই একমাত্র বাস্তবিক পন্থা নয়, বরং একমাত্র পন্থা হছে সত্যকে স্বীকার করা এবং তাকে আমাদের পক্ষে সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করা। এদিক দিয়ে ভারতীয় ঐক্য আবিষ্কার করার উপরই প্রকৃতপক্ষে ভারতের ও এশিয়ার ভাগ্য নির্ভর করে। ভারতই হচ্ছে ক্ষুদ্রতম এশিয়া। তার অধিবাসীদের অংশ বিশেষের সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য রয়েছে এশিয়ার পূর্ব অঞ্চলের জাতিসমূহের সাথে এবং অপর অংশের সাদৃশ্য রয়েছে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার জাতিসমূহের সাথে। ভারতে যদি কোনো কার্যকরী সহযোগিতার নীতি খুঁজে বের করা যায়, তাহলে তা এই প্রাচীন দেশে শান্তি ও পারস্পরিক সদিচ্ছা আনবে – যে দেশ তার অধিবাসীদের সহজাত অক্ষমতার কারণের চাইতেও বেশী করে তার ঐতিহাসিক অবস্থানের কারণে এত দীর্ঘকাল দুঃখ ভোগ করছে। এবং এক সময়ে এটি সম্পূর্ণ এশিয়ার রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করবে।
এটা অবশ্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে, এমনি একটা অভ্যন্তরীণ ঐক্যের নীতি খুঁজে বের করার জন্য আমাদের অতদিনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কেন সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো? সম্ভবতঃ, আমরা পরস্পরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করি এবং ভিতরে ভিতরে পরস্পরের উপর আধিপত্য বিস্তার করার লক্ষ্য পোষণ করি। অবস্থা বিশেষে আমরা যেসব একচেটিয়া অধিকার লাভ করেছি, পারস্পরিক সহযোগিতার উচ্চতর স্বার্থের খাতিরেও আমরা সম্ভবতঃ তা ত্যাগ করতে পারছি না এবং আমরা আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতাকে গোপন করছি জাতীয়তাবাদের আবরণে। বাইরে আমরা মহান দেশাত্মবোধের প্রেরণা যোগাই, কিন্তু ভিতরের দিকে আমরা জাত বা গোত্র বিশেষের মতোই সংকীর্ণমনা। সম্ভবতঃ আমরা স্বীকার করতে চাই না যে, প্রত্যেক দলেরই তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী অবাধ আত্মবিকাশের অধিকার রয়েছে। কিন্তু আমাদের ব্যর্থতার কারণে যা-ই হোক, আমি এখনো আশান্বিত। ঘটনাপ্রবাহ কোনো বিশেষ ধরনের অভ্যন্তরীণ ঐক্য প্রতিষ্ঠার দিকেই প্রবাহিত হচ্ছে বলে মনে হয়। মুসলিম মন সম্পর্কে আমি যতোটা পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছি, তাতে আমার একথা ঘোষণা করতে কোনো দ্বিধা নেই যে, ভারতীয় মুসলিম তার নিজস্ব ভারতীয় আবাসভূমিতে নিজস্ব তমদ্দুন ও ঐতিহ্যের ধারা অনুযায়ী পূর্ণ ও অবাধ আত্মবিকাশের অধিকারী, স্থায়ী সাম্প্রদায়িক মীমাংসার বুনিয়াদ হিসাবে এই সত্য স্বীকৃতি হলে সে ভারতের আযাদীর জন্য তার সর্বস্ব বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকবে।
প্রত্যেক গোষ্ঠী তার নিজস্ব ধারায় স্বাধীনভাবে আত্মবিকাশের অধিকার রাখে, এই নীতি কোনো সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব দ্বারা অনুপ্রাণিত নয়। সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। যে সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়ের প্রতি খারাপ মনোভাব পোষণ করে সে নীচ ও ঘৃণার্হ। অপর সম্প্রদায়সমূহের রীতিনীতি, কানুন, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের প্রতি আমি উচ্চতম শ্রদ্ধা পোষণ করি। এমন কি, কুর'আন শরীফের শিক্ষা অনুযায়ী প্রয়োজন হলে তাদের উপাসনাগারসমূহ সংরক্ষণ করাও আমার কর্তব্য। তথাপি যে সাম্প্রদায়িক দল আমার জীবন ও আচরণের উৎস এবং যার ধর্ম, যার সাহিত্য, যার চিন্তাধারা, যার তমদ্দুন আমায় বাস্তবে রূপায়ন করেছে এবং আমার চেতনায় যার সম্পূর্ণ অতীত এক জীবন্ত কার্যকরী উপাদান হিসাবে পুনরুজ্জীবন লাভ করেছে, সেই বিশেষ সাম্প্রদায়িক দলটিকে আমি ভালোবাসি। এমন কি, নেহরু রিপোর্টের প্রণেতাগণও সাম্প্রদায়িকতার এই উচ্চতর বৈশিষ্ট্যের মূল্য স্বীকার করেন। সিন্ধুর পৃথকীকরণের আলোচনা করতে গিয়ে তাঁরা বলেন: "To say from the larger viewpoint of nationalism that no communal provinces should be created, is, in a way, equivalent to saying from the still wider international viewpoint that there should be no separate nations. Both these statements have a measure of truth in them. But the staunchest internationalist recognizes that without the fullest national autonomy it is extraordinarily difficult to create the international State. So also without the fullest cultural autonomy – and communalism in its better aspect is culture – it will be difficult to create a harmonious nation." – “কোনো সাম্প্রদায়িক প্রদেশ সৃষ্ট হওয়া উচিত নয়, জাতীয়তাবাদের বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ কথা বলতে যাওয়া আরো ব্যাপকতর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এইরূপ বলারই সমার্থক যে, কোনো স্বতন্ত্র জাতির অস্তিত্ব থাকা উচিত নয়। এই উভয় উক্তির মধ্যেই কতকটা সত্য নিহিত রয়েছ। কিন্তু সর্বাধিক নিষ্ঠাবান আন্তর্জাতিকতাবাদীও স্বীকার করেন যে, পূর্ণতম জাতীয় স্বাধিকার ব্যতীত আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা অত্যধিক দুরূহ। তেমনি পূর্ণতম সাংস্কৃতিক স্বাধিকার ব্যতীত এক ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়ে তোলাও হবে কঠিন, কেননা সাম্প্রদায়িকতার অধিকতর ভাল দিকই হচ্ছে সংস্কৃতি।”
সূত্র: ইকবাল একাডেমি করাচী থেকে প্রকাশিত সৈয়দ আব্দুল মান্নান সম্পাদিত ‘পাকিস্তানের ঐতিহাসিক পটভূমিকা’ গ্রন্থ (সংশোধিত এবং পরিমার্জিত)।
0 Comments