**********
আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বেও আমাদের কাছে বেঁচে থাকার ও সুস্থ থাকার ন্যূনতম উপকরনগুলির চাহিদাই ছিল মূখ্য। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা এইগুলিই ছিল অধিকাংশ জনগনের জীবন সংগ্রামের উদ্দেশ্য। তখন বিলাসিতা-মনোরঞ্জন- ফূর্তি করার খুব একটা সময়-অর্থ ও মানসিকতা ছিল না।
তাই একজন ভাল কৃষক, একজন দক্ষ দর্জি, একজন ভাল কাজ জানা মিস্ত্রি, একজন শিক্ষক, একজন হাতুড়ে ডাক্তার সমাজে খুব সম্মানের সাথে চলত। খুব নামডাক থাকত তাদের সমাজের মধ্যে।
এইসব কাজে যার ই যোগ্যতা ও দক্ষতা ছিল,- তারই অর্থ, সম্মান,জনবল ছিল।
এই কাজ জানা, দক্ষ, সমাজের প্রকৃত উন্নতির কারিগর মানুষরাই ছিল যুবসমাজের আদর্শ, প্রকৃত সম্মানের অধিকারী। তাই সেই যুবসম্প্রদায়ের অধিকাংশেরই একটা তাগিদ ছিল নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা বৃদ্ধি করে সমাজের বাঁচা-বাড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করার।
ধীরে ধীরে আমাদের আর্থিক অভাব ঘুচতে লাগল। অভাব ঘুচে প্রাচুর্য আসল। তখন আর অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা আমাদের মূখ্য উদ্দেশ্য রইল না। বেঁচে থাকার ও সুস্থ থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনগুলি পেরিয়ে আমরা ঝুঁকতে লাগলাম বিলাসিতা-ফূর্তি-আরাম আয়েস ও স্ট্যাটাসের দিকে। তখন ধীরে ধীরে কৃষক-দর্জি-মিস্ত্রি-শিক্ষক-ডাক্তার ইত্যাদি সমাজ বন্ধুদের কদর কমতে লাগল। তার জায়গায় স্থান করে নিল সেই সকল লোকগুলি যারা আমাদের বিলাসিতা-মনোরঞ্জন-আরাম আয়েস ও স্ট্যাটাসের খোরাক জোগাতে সক্ষম। সিনেমার নায়ক-নায়িকারা, যারা নেচে-কুঁদে, গান গেয়ে, লাফালাফি করে, যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে আমাদের বিলাসিতা ও মনোরঞ্জনের চাহিদা মেটাতে সক্ষম,- তাদের কদর বেড়ে গেল মাত্রাতিরিক্ত। ক্রিকেট খেলোয়াড়রা, যারা নানা দেশীয় এবং আআন্তর্জাতিক ময়দানে খুব ভাল খেলার প্রদর্শন করে আমাদের ঘন্টার পর ঘন্টা মনোরঞ্জন করতে সক্ষম তারাই আমাদের চরম সম্মানের ও খ্যাতির অধিকারী হল। অঢেল টাকার মালিক হল। বেঁচে থাকার চেয়ে স্ট্যাটাসই হল আমাদের জীবন সংগ্রামের উদ্দেশ্য।
গরুর দুধের চেয়ে coca cola
র দাম অনেক বেশী হয়ে গেল। ভাতের চেয়ে পিজ্জার সম্নান বেশী হয়ে গেল। একটা ভদ্র পোশাকের চেয়ে ছেড়া জিন্সের দাম অনেক বেড়ে গেল। একটা ঘর বানানোর ইঞ্জিনিয়ারের চেয়ে ইন্টেরিয়র ডিজাইনার এর কদর বেশ বেড়ে গেল। একজন ভাল ডাক্তারের দক্ষতার চেয়ে ও কর্পোরেট হাসপাতালের ব্র্যান্ডের ছাপ অনেক গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠল।
একজন গুনগত শিক্ষকের চেয়ে ও নামডাক ওয়ালা কোচিং সেন্টারের চাহিদা বেড়ে গেল।
এমন ভাবেই ধীরে ধীরে সিনেমার নায়ক-নায়িকা, ক্রিকেট খেলোয়াড়, পয়সাওয়ালা রাজনৈতিক নেতা এইসব লোকগুলি যুবসম্প্রদায়ের আদর্শ হয়ে উঠতে লাগল। এই লোকগুলি অর্থবল, জনবল, খ্যাতি সবদিক দিয়ে শীর্ষে অবস্থান করতে লাগল। একজন দক্ষ কৃষক, একজন দক্ষ ও সৎ শিক্ষক, একজন বিজ্ঞানী, একজন প্রকৌশলী, একজন গবেষক, একজন চিকিৎসক তাদের সম্মান, অর্থ ও খ্যাতির সামনে তুচ্ছ বলে পরিগনিত হতে লাগল। যুবসম্প্রদায় ভুল পথে পরিচালিত হতে লাগল।
আজকে আমাদের সমাজের কোন যুবককে যদি পাঁচজন বিজ্ঞানী, পাঁচজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক,পাঁচজন নামকরা ডাক্তার, পাঁচজন বিখ্যাত প্রকৌশলীর নাম জিজ্ঞেস করা হয়,- তাহলে তার " ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা " হবে। কিন্তু, তাকে পাঁচজন হিন্দি সিনেমার নায়ক বা নায়িকার নাম জিজ্ঞেস করুন, পাঁচজন নামকরা ক্রিকেটারের নাম জিজ্ঞেস করুন, পাঁচজন নেতার নাম জিজ্ঞেস করুন,- সে তাদের জন্মবৃত্তান্ত থেকে শুরু করে, তারা কি খায়, কয়টা গাড়ী আছে, কোন কোম্পানির পোশাক পড়ে,কয়টা পরকীয়া করে,- সব মূখস্থ বলে দেবে।
এই যুবসম্প্রদায়ের কাছ থেকে দেশের উন্নতির যোগান আশা করা বৃথা। তারা ছেড়া জিন্স আর লেজ উঁচু বাইক পেলেই খুশী।
আমাদের রাষ্ট্রের কাছে ও কৃষি- স্বাস্থ-শিক্ষার চেয়ে যুদ্ধ সরঞ্জাম কিনে বিশ্বের দরবারে স্ট্যাটাস দেখানোটাই মূখ্য হয়ে উঠল। যুদ্ধের সরঞ্জাম কিনতে রাষ্ট্র আজ অব্দি যে খরচ করেছে তার সিকিভাগ ও যদি কৃষি-স্বাস্থ্য-শিক্ষার ক্ষেত্রে করত তবে আজকে দেশের জনগনের জীবনযাত্রার মান অন্যরকম থাকত। কিন্তু কিছু করার নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে এমন করতেই হবে। সারা পৃথিবীর সবগুলি দেশ যুদ্ধ সরঞ্জামের পেছনে যে অর্থ, শ্রম, মেধা ব্যায় করেছে সেগুলি যদি মানুষের জীবনের মানোন্নয়নে খরচ করা হত তবে বিশ্বে দরিদ্রতা বলে কিছু থাকত না।
আজকে করোনা চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের ভুলগুলি। আমরা বেঁচে থাকার চেয়ে বিলাসিতাকেই মূখ্য করে এসছি এতদিন। আশা করি, - করোনা প্রকোপের পর আমাদের মানসিকতা বদলাবে, বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র যুদ্ধাস্ত্র কেনার প্রতিযোগিতা থেকে সরে এসে কৃষি-,শিক্ষা-স্বাস্থ্য-গবেষণার দিকেই বেশী মনোযোগী হবে। আশা করি এক পরিবর্তিত নতুন বিশ্ব দেখতে পাব।
*************************
0 Comments