পুস্তক সমালোচনায় *ভার্গবী*

____________________
প্রবীর ঘোষ রায় ও সুব্রতা ঘোষ রায় আমাদের দুজন প্রিয় মানুষের নাম । জীবনে ও যাপনে এঁরা দুজন কবি-দম্পতি - এ কথা অনেকেই জানেন । আমাদের গৃহবন্দীকালীন অবস্থায় স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা " উদার আকাশ" এই দম্পতির একজোড়া কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছে । দুটি বই নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়, আমি সংক্ষেপে কিছু প্রতিক্রিয়া আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই ..

কাব্যগ্রন্থ : *জল যেন কবিতা'*
কবি: *সুব্রতা ঘোষ রায়*


'জল যেন কবিতা' নাম দিয়েই বলা শুরু করি। কারণ এ বইয়ের কবিতা - জলের মতোই তার চলন। ঝরঝর করে বয়ে চলেছে কখনো ঝর্নার মতো, কখনো নদীর মত। কখনো দিঘির মতো টলটলে এক স্বচ্ছতা। কখনো যেন সমুদ্রের  পাড়ে এসে ভেঙে পড়া ঢেউ।  
 তৃষ্ণা মেটাতে কোনো অপূর্ব মনোহরা শরবত পারে না, জলই পারে ঠিকমতো তৃষ্ণা মেটাতে।
কবিতাগুলোর সহজ স্বাচ্ছন্দ্য যেন সত্যি তৃষ্ণার্তর জন্য জলের মতোই সুখকর। হ্যাঁ সুখকর। স্বাচ্ছন্দ্যে একটা সুখ থাকে। সেটা এ বইয়ের অক্ষরে অক্ষরে বর্তমান। আর বইয়ের পাতা থেকে সে স্বাচ্ছন্দ্য কখন যেন মনের আরাম হয়ে ওঠে ঠিক অনুমান করতে পারি না। কঠিন শব্দে বাঁধা নয়, এখানে অনুভূতিরা কেমন যেন পুতুল খেলা মেয়েটির মতো, মায়ের রান্না করে আসার পর ওই একটা নুন হলুদের হাত মোছা শাড়ির গন্ধের মতো। 
সুব্রতা ঘোষ রায় এর লেখার সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য তাঁর পরিমিতি বোধ। তাঁর ছন্দ কষ্ট অর্জিত নয়। সহজ, সাবলীল। ভারী ভাষার ভিড়ে নয়, তাঁর  অনুভূতিগুলোর বসবাস কেমন যেন চায়ের কাপে, মায়ের আঁচলে। ধরা ছোঁয়ার মধ্যে এক সহজিয়া ভাষা নিয়ে তার কারবার।
"বিষাদের দিনলিপি" র মতো গভীর বিষয়ের কবিতাতেও কী অদ্ভুতভাবে ছুঁয়ে ফেলেন তোমার আমার তাঁর বিষাদ।



"প্রথম বাড়াবাড়ি" কবিতাটি ব্যাক্তিগত ভাবে আমার মনের কাছে। কবির সার্থকতা এখানেই, তাঁর লেখা কখন যেন পাঠকের মনের জমা কথার প্রকাশ হয়ে ওঠে।
আজকালকার বড়ো ভারাক্রান্ত শব্দ চয়নের কঠিন কবিতা লেখার যে একটা ফ্যাশন, সেখানে দাঁড়িয়ে সুব্রতা ঘোষ রায় সহজ কথাকে সহজে বলেছেন। কঠিন অনুভূতিকে অনায়াসে ছুঁয়ে গেছেন সহজ কথার কবিতা দিয়ে।
কখনো ব্যক্তিগত জীবনের অসুখের থেকে অ এর বিয়োগফল বের করেছেন, কখনো চিলেকোঠার ঘরে সেই ভালবাসার ছন্দ, অথবা স্বামী স্ত্রীর চিরকালীন দ্বন্দ, সবেতেই এই কবি বড়ো বেশী স্বচ্ছন্দ্য।



কাব্যগ্রন্থ : *কবির জন্য*
কবি: *প্রবীর ঘোষ রায়*

প্রবীর ঘোষ রায় এর "কবির জন্য" কবিতার বইটি কবির জন্য না থেকে কেমন করে যেন হয়ে গেছে তোমার আমার বা তাঁর। কখনও সংসারের টাকা থেকে বাঁচিয়ে রাখা টাকায় বরের জন্য কেনা শার্টের গল্পটা খুব চেনা লাগে। কখনো ছেলের সাথে পাহাড়ে মেঘ ডুব দেওয়ার গল্পটা কবির একার থাকে না, যে বা যারা পড়ছেন কবিতাটা তাঁদের গল্প হয়ে ওঠে। কবির প্রিয় বৃষ্টি। কবিতার বইটি জুড়ে তাই মাঝে মাঝেই "শ্রাবণ" ফিরে আসে বৃষ্টির হাত ধরে। কবি কিন্তু শুধু মেঘ বৃষ্টির নরম মন নিয়ে বাঁচেন না। জীবন যুদ্ধ তাঁর লেখায় বারবার ফেরে। অস্ত্র শাণিত হয় ক্ষুরধার ভাষায়। এ কবি সাদাকে সাদা কালোকে কালো ধূসরকে ধূসর বলতে জানেন। কখনো তাঁর কবিতা "নীল" সাগর জলে আকাশ চেনায়, কখনো চেনায় সাগরতটে  "সাগর টি স্টল" এর  নিত্য জীবনের বেঁচে থাকাকে। কখনও কবিতায় "মা" এর স্নেহ কখনও বা মনিদির নীল "আঁচল"। কবি কখনও বলেন একের কথা, কখনো বলেন সমষ্টির কথা। তাই তিনি কখনো বলেন "মানুষের গল্প", কখনো বলেন "লোকটার গল্প"। খানখান হওয়া যন্ত্রণার "ফিমেল ওয়ার্ড" বা চোখের জলে ঝাপসা হওয়া "সময়"। জীবন ছুটছে। কবিতার জন্য জীবনের কাছে সময় বড়ো কম। কবির আফসোস যদি জীবনের জন্য জীবনের হাতে একটু সময় থাকতো তবে চিলেকোঠার ঘরে আজও কবিতাদের জন্ম হতো।
"জীবন" কবিতা থেকে কবির কথা ধার করে বলি এ বই কেন পড়া দরকার। হ্যাঁ দরকার, পড়া দরকার কারণ: 
"আমার সহজ ভাষা
বলে যাই কবিতায়
সেসব তোমারও কথা
কেবল আমার নয়।"

সম্প্রতি *'উদার আকাশ'* থেকে প্রকাশিত হয়েছে এই দুটি কাব্যগ্রন্থ । পাওয়া যাচ্ছে : *নিউ লেখা প্রকাশনী*, ৫৬ ডি কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০৭৩
_______________

*ভার্গবী*