ভারতের স্বাধীনতার ফাঁকির ইতিহাস আলোচনা করার আগে ভারত পরাধীন হল কি ভাবে তা আলোচনা করা প্রয়োজন। ১৭৫৭ সালে ২৩ শে জুন পলাশির আমবাগানে নবাব সিরাজ উদ দৌল্লার পতনের পর থেকেই ভারতের পরাধীনতা শুরু হয়। এই পরাধীনতার পিছনে ছিল ব্রাহ্মণ জমিদার শ্রেণী ও ইংরেজ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ষড়যন্ত্র। এবং যেখানে মীর জাফর ছিলেন উপলক্ষ্য মাত্র। ঐতিহাসিক তপন মোহন চট্টোপাধ্যায় 'পলাশীর যুদ্ধ ' গ্রন্থে খোলাখুলি ভাবে লিখেছেন যে," ষড়যন্ত্রটা আসলে হিন্দুদেরই ষড়যন্ত্র। পশ্চিম বঙ্গে তখন বীরভূম ছাড়া আর সব জায়গাতেই হিন্দু জমিদার... প্রকাশ্যে না হলেও ভিতরে প্রায় সব জমিদারই এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।" (১ ম মুদ্রন, পৃঃ ১৫৬) হিন্দু বলতে এখানে বামুন কায়েতদের বুঝতে হবে কেননা ব্রাহ্মণ প্রভাবিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা না জমিদার ছিল না তারা সরকারে যুক্ত ছিল। তাই আম ভাবে সকল হিন্দু কে দায়ী করা ঠিক নয়।
আসলে ব্রাহ্মণরা নিজেদেরকে সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করেন। কারণ তাদের শাস্ত্রমতে তারা ব্রহ্মার মুখ থেকে এসেছে। তাই দেশ শাসন ও নীতি চলবে ব্রাহ্মনদের দ্বারাই। কোন অনার্য বা অব্রাহ্মণ দেশ শাসন করবে এটা তারা কখনই মেনে নিতে পারেনি। যদিও কোন অব্রাহ্মণ দেশ চালায়, তা হলে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আইন মেনেই তাকে দেশ চালাতে হবে। তাই আমরা দেখতে পেয়েছি প্রাচীন কাল থেকেই আর্য ব্রাহ্মণরা বৌদ্ধ শাসনের বারবার পতন ঘটিয়েছে। আর ঠিক এই কারণের জন্যই মুসলিম শাসন তারা কোনদিনই মেনে নিতে পারেননি।
বিমালানন্দ শাসমল লিখেছেন, একথা ভুললে চলবেনা ভারতবর্ষে হিন্দুরা বহুদিন থেকেই মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নিজেদের পারস্পরিক অনৈক্য ও সামাজিক দুর্বলতার জন্য মুসলমান শাসনের বিরুদ্ধে তারা কার্য্যকরী কিছু করে উঠতে পারেননি। কিন্তু ইংরেজদের আগমনে ভারতের হিন্দুদের বহুদিনের অবদমিত আকাঙ্খা সম্পূর্ণ হবার অবকাশ পেল। ভারতবর্ষের সিংহাসন থেকে মুসলমানদের সরিয়ে হিন্দুরাই বসিয়েছিল ইংরেজকে। পলাশির যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে বিখ্যাত মারাঠা নায়ক বালাজি বাজি রাও ক্লাইভকে চিঠি লিখে জানিয়ে ছিলেন যে, তিনি বাংলার নবাব সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে ইংরেজ দের নিজে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে পস্তুত আছেন।" (স্বাধীনতার ফাঁকি, বিমালানন্দ শাসমল পৃঃ ৭৮)। এই ভাবে ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে নবাব সিরাজ উদ দৌলার পতন ঘটিয়ে ভারতকে পরাধীনতার মুখে ঠেলে দেয়।
এর ফলে বিরাট সংখ্যক ভারতবাসীর উপর নেমে আসে শোষণ, নিপীড়ন ও অত্যাচারের স্টিমরোলার। যেহেতু ব্রাহ্মনবাদীরা নবাব সিরাজ উদ দৌলার পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, সেহেতু তাদেরকে বেশি বেশি জমিদারি প্রদান করেছিল, যাকে ইতিহাসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। বিমালানন্দ শাসমল লিখেছেন, ১৭৯৩ সালের ইংরেজরা যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন করেন, তাতে ভারতবর্ষের রাজস্বের একটা তৎকালীন সমাধান হয়েছিল বটে কিন্তু এরদ্বারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দরিদ্র মুসলমান কৃষকের অসহায়তাকেও চিরস্থায়ী করে দেওয়া হয়।... ইংরেজদের আগমনকে সাধারণ ভাবে হিন্দুরা স্বাগতম জানিয়েছিলেন। সেই জন্য ইংরেজরাও হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চুক্তি করেছিলেন। (স্বাধীনতার ফাঁকি, পৃ ৭৩)। এই সমস্ত ব্রাহ্মণ্য বাদী জমিদার ও ইংরেজরা অস্পৃশ্য হিন্দু ও মুসলিম দরিদ্র কৃষকদের শোষণ করেছিল। এই জন্য মীর নিসার আলি বা তিতুমীর, দুদুমিয়া, সৈয়দ আহমদ বেরলভি, হাজি শরিয়াতুল্লাহ, সিধু, কানহু প্রমুখ ব্রিটিশ বিরোধিতার পাশাপাশি এই ব্রাহ্মণ্যবাদী জমিদারদের বিরুদ্ধে ও লড়াই চালিয়ে ছিল।
ইংরেজ ও জমিদারদের শোষণের মাত্রা অত্যাধিক বৃদ্ধির কারণে ১৮৫৭ র মহাবিদ্রোহ শুরু হয়। এই যুদ্ধে শুধু সৈনিকরা নয় বিরাট সংখ্যক মুসলিমরা অংশগ্রহণ করেছিল। বিমালানন্দ শাসমল লিখেছেন, "১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মুসলমানেরা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভারতের ভূম্যাধিকারি দল যাদের অধিকাংশই হিন্দু ছিলেন তারা নিষ্ঠার সঙ্গেই ইংরেজদের সাহায্য ও সমর্থন করেছিলেন। " (স্বাধীনতার ফাঁকি পৃ ৭৪)
পূর্বে বলা হয়েছে বামুন কায়েতরাই বেশি জমিদার ছিল।
এই ব্রাহ্মণ্যবাদীরা আবার নিজেদের আরো বেশি দাবী আদায় করার জন্যে ব্রিটিশদের সহায়তায় ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস গঠন করেন। যেখানে এক জাতিই ছিল না সেখানে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা জাতীয়তাবাদের মুখোশ পরে রাতারাতি জাতীয়তাবাদী হয়ে যায়। আবার এই জাতীয় কংগ্রেস যে ব্রাহ্মণদের প্রতিষ্ঠান সেকথা বুঝতে না দেবার জন্য মুসলিম, শূদ্র, অস্পৃশ্য সমাজের ব্যক্তিদের নিযুক্ত করেন। যাতেকরে সকল ভারতবাসী যেন মনে করে জাতীয় কংগ্রেস সকলের অধিকার আদায়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু কংগ্রেসের মুখোস ক্রমে ক্রমে খসে পড়তে শুরু করে।
অপরদিকে ১৯০৬ খ্রীস্টাব্দে মুসলিম লীগ গঠিত হয়। যদিও সমস্ত মুসলিম, মুসলিম লীগে যোগদান করেননি। তবে মুসলিম গঠীত হবার পর হিন্দু ও মুসলিম বিভেদ আরো তীব্র হতে থাকে। ঠিক এই পরিস্থিতে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসকে ১৯১৬ সাল লক্ষ্নৌ চুক্তির মাধ্যমে এক প্লাটফর্মে আনেন যা ভারতের জাতীয় সংহতির ইতিহাসে এ ছিল মিঃ জিন্নার অবিস্মরণীয় অবদান। এই সময় মিঃ জিন্নাহ যখন দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে নিয়ম তান্ত্রিক পথে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন অনগ্রসর হচ্ছিলেন তখন গান্ধিজী ব্রিটিশ সরকার কে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন। (দ্রঃ ভারত কাহিনী, অধ্যাপক সৌমেন্দ্রলাল রায়)। এই জন্য ব্রিটিশ সরকার গান্ধীজীকে কায়জার ই হিন্দ উপাধি প্রদান করে।
লক্ষ্ণৌ চুক্তির সমার্থক অনেক হলেও গান্ধীজী এই ন্যায় ইনসাফ ভিত্তিক চুক্তিকে শিক্ষিত ও ধনী হিন্দু ও মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে বোঝাপড়া বলে মনে করেন। আসলে কংগ্রেসে জিন্নাহর প্রাধান্য গান্ধিজী কখনো মেনে নিতে পারেন নি। তারপর মিঃ গান্ধী জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রসর হন। ফলে জিন্নাহ জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করেন ১৯২০ সালে।
অপর দিকে শূদ্রনেতা পেরিয়ার জাতীয় কংগ্রেসে প্রবেশ করে ১৯২০ সালে। চাকরিতে শূদ্রদের সংরক্ষণ চাওয়ায় ব্রাহ্মণ্যবাদী মাফিয়া গোষ্ঠীর হাতে মার খেলেন। এই সময় গান্ধিজী পেরিয়ারকে পত্রলিখে জানালেন," সমাজের স্বার্থে বর্ণাশ্রম প্রয়োজন। জাতিগত সংরক্ষণ দিলে বর্ণাশ্রম প্রথা ধ্বংস হয়ে যাবে। " এর ফলে পেরিয়ার বুঝতে পারলেন জাতীয় কংগ্রেস ব্রাহ্মণদের সংগঠন। তারপর তিনি জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করে ১৯২৫ সালে। পেরিয়ার জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করে বলেছিলেন, "এখন থেকে আমার কাজ হবে কংগ্রেসকে ধ্বংস করা, কেননা এটা ব্রাহ্মণদের একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান।"
(একনজরে পেরিয়ার রামস্বামী নাইকার পৃঃ ৯, ডঃআম্বেদকার প্রকাশনী, কলকাতা) । গান্ধিজী ১৯২২ সালে বারদৌলির সিন্ধান্তে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন- আন্দোলনে হিংসা ঢুকে গেছে এই অজুহাতে।
১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্ট বা হিন্দু মুসলিম মিলন চুক্তি কংগ্রেস প্রত্যাহার করেনিল। ২৯২৮ সালে নেহেরু রিপোর্টে জিন্নাহ ১৪ দফা দাবি অগাহ্য করা হয়েছিল। জিন্নাহ বলেছিলেন, "আমরা সকলে একই ভূমির সন্তান আমাদের এক সঙ্গে থাকতে হবে। আমাকে বিশ্বাস করুন যতদিন না হিন্দু মুসলিম ঐক্যবদ্ধ হয় ততদিন ভারতের কোন অগ্রগতি হবে না।" (আধুনিক ভারতের ইতিহাস পৃঃ ৬৬৪, সিদ্ধার্থ গুহরায় ও সুরঞ্জন চক্রবর্তী) কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব এই আহ্বানে সাড়া দেয় নি।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে জাতীয় কংগ্রেস ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রতিষ্ঠান। যারা সমতার আদর্শে বিশ্বাসী ছিলনা। তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করেছিলেন। যা ডঃ বি আর আম্বেদকর উল্লেখ করেছেন, জাতীয় কংগ্রেস কি স্বাধীনতার জন্য লড়ছে? না ক্ষমতা লাভের জন্য লড়ছে? (অস্পৃশ্য সমাজের মুক্তি ও গান্ধিজী, ডঃআম্বেদকার প্রকাশনী, কলকাতা)
ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতীয় কংগ্রেস দল জিন্নাহ ন্যায় ভিত্তিক প্রস্তাব না মেনে ভারত ভাগ মেনে নিলো। ঐতিহাসিক আয়েশা জালাল লিখেছেন, " ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ খ্রীস্টাব্দে পর্যন্ত জিন্নাহ বা লীগ পৃথক পাকিস্তানের দাবি স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেননি।" আয়েশা জালাল আরো মনে করেন, লাহোরে প্রস্তাব ছিল জিন্নাহ এক কৌশলী চাপ সৃষ্টিকারী চাল।... জিন্নাহ দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, বিভাজন এড়ানোর জন্য কংগ্রেস এই দাবি মেনে নেবে। জিন্নাহর এই ধারণাটি ছিল মহা ভুল ও বিপর্যয়ের কারণ। কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত দেশ বিভাগের মধ্যেই সমাধান খুঁজে নেয়।( The sole spokesman jinnah Muslim League and Demand for Pakistan) গবেষক অসীম রায় বলেছেন, দিনের শেষে লীগ নয় কংগ্রেসই ভারতমাতার দেহে ছুরিকাঘাত করেছিল।" এই ব্রাহ্মণ্যবাদীরা শুধু ভারত ভাগ করেই ছাড়েনি বাঙলা ভাগও করেছিলেন। ( দ্র বাঙলা ভাগ হল জয়া চ্যাটার্জী, ঢাকা)
পরিশেষে ভারত ও বাংলা ভাগের মধ্য দিয়ে ভারত স্বাধীনতা লাভ করল। স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নেহেরু, গর্ভনর জেনারেল হলেন চক্রবর্তী রাজাগোলাচারি, সেনাপতি সহ দু একজন বাদ দিয়ে সকলেই ব্রাহ্মণ। ডঃ আম্বেদকর এজন্য স্বাধীনতা সম্পর্কে বলেছেন যে, "
বর্তমান ভারতের স্বাধীনতা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের স্বাধীনতা আমরা এখনো ওদের দাস।" (ব্লু বুক ডঃ আম্বেদকর প্রকাশনী)। বিমালানন্দ শাসমল একই অভিযোগ করেছেন, "আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে দেশের উচ্চবর্ণ উদ্ভূত শিক্ষিত সমাজ সকল প্রকার আন্দোলন থেকে এই শোষিত প্রবঞ্চিতের বিরাট দলকে সযত্নে পরিহার করে দূরে সরিয়ে রাখলো।যুগযুগ ধরে যারা সমাজ পরিচালনার ক্ষমতা করায়ত্ত করে রেখেছিল উচ্চবর্ণের সেই শিক্ষিত সমাজ স্বাধীনতা সংগ্রামকেও নিজেদের মধ্যে গোণ্ডিবদ্ধ রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে রইল। কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতা যদি আসে সেটা যেন তাদের হাতেই আসে। দেশের নিচের তলার মানুষ খেটে খাওয়া কৃষক শ্রমিক যেন সেই ক্ষমতার কিয়দংশ না লাভ করতে পারে। যুগযুগ ধরে দেশে এটাই হয়ে এসেছে"।(স্বাধীনতার ফাঁকি, বিমালানন্দ শাসমল পৃঃ ১৬৫)।
অর্থাৎ অনার্য অব্রাহ্মণ ভারতবাসী ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত হতে পারলেও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাত থেকে মুক্ত নয়।বর্তমানে অনার্য দলিত (এস সি, এস টি, ওবিসি, সংখ্যালঘু) ও মুসলিমরা সি পি এম, তৃণমূল, কংগ্রেস, বিজেপি প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্য বাদী পার্টির গোলাম।
নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু স্বাধীনতার লক্ষ্য সম্পর্কে বলেন, "স্বাধীনতার লক্ষ্য কেবল রাজনৈতিক বন্ধন থেকে মুক্তি নয়, এর লক্ষ্য সম্পদের সম বন্টন, জাতিভেদ প্রথার অবসান ও সামাজিক সাম্যের প্রতিষ্ঠা। এই স্বাধীনতার লক্ষ্য সাম্প্রদায়িকতার অবসান এবং ধর্মীয় সহনশীলতার বাতাবরণ তৈরি করা।" সুভাস চন্দ্রের উক্তিদিয়ে ব্যখ্যা করলেই ভারতের স্বাধীনতার ফাঁকি ধরা পড়ে যাবে।
ক) সম্পদের সম বন্টনঃ
..................................
সম্পদের সম বন্টনের কথা দূরে, সামান্য বেঁচে থাকার মত সম্পদ কি নিম্নবর্ণের হিন্দু এসসি / এসটি / ওবিসি ও সংখ্যালঘু তথা দলিত ও মুসলিম সমাজের মানুষরা পেয়েছেন? বিবিসি এক সমিক্ষায় জানিয়েছেন বিশ্বের অপুষ্টিতে আক্রান্ত প্রতি চারটি শিশুর মধ্যে একটি ভারতের। দেশে এই অপুষ্টির শিকার কাদের শিশুরা? নিশ্চয় সোনিয়া গান্ধীর সন্তান নয়, মমতা ব্যানার্জীর আত্মীয় নয়, আদবানি, বাজপেয়ী,অমিত সাহ, প্রণব মুখার্জি, সোমনাথ ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের নাতি নাতনি নয়। এই পুষ্টিহীন সন্তানরা নিম্নবর্ণের এস সি/ এস টি/ ওবিসি ও সংখ্যা লঘু তথা দলিত ও মুসলিম সমাজের।
খ) জাতিভেদ প্রথার অবসানঃ
.........................................
জাতিভেদ প্রথা আমাদের দেশে যুগযুগ ধরে বিদ্যমান। বর্তমান ভারতেও বহাল তবিয়তে। জাতিভেদের স্বীকারে রহিত ভেমুলা আত্ম হত্যা করতে বাধ্য হতে হয়েছিল। দিল্লির জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা কৌশল পাওয়ার বলছে স্কুলে নিজের হাতে তিনি জল ভরে খেতে পারতেন না। কৌশল পাওয়ার পোস্ট গ্যাজুয়েট হওয়ার পরও বিশ্ব বিদ্যালয়ের হোস্টেলে তার জায়গা হয়নি। ভাবতে অবাক লাগে। উত্তর প্রদেশে দলিত ছাত্র ছাত্রীদের আলাদা জায়গায় বসতে হয়। পশ্চিম বঙ্গে ও উঁচু-জাতের ছেলেমেয়েরা নিচু জাত ও মুসলিম রাঁধুনীদের হাতে তৈরি মিড ডে মিল খায় না। পূর্ব মেদনী পুরের বেগুনবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের তপশিলি জাতির কোটায় ডঃ কালীপদ ঘোড়ুই প্রধান শিক্ষক হওয়ায় তাঁর স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকরা তপশিলি বলে তাঁকে মেনে নিতে পারেননি। তাদের বক্তব্য ছিল "একজন তপশিলিভুক্ত ব্যক্তিকে তারা প্রধান শিক্ষক হিসেবে মেনে নেবেন না।" পশ্চিম বঙ্গে আজও পর্যন্ত দলিত ও মুসলিমদের মুখ্যমন্ত্রী হতে দেখা গেল না।অর্থাৎ জাতিভেদ প্রথার অবসান আজও হয়নি।
গ) সাম্প্রদায়িকতা অবসানঃ
.......................................
ভারত স্বাধীন হবার পর থেকে একাধিকবার ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কালো মেঘ আকাশে ছেয়ে গেছে। স্বাধীন ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হবে কেন? ধর্মীয় সহনশীলতার বাতাবরণ কেমন সৃষ্টি হয়েছে তা অসমের চা শ্রমিক ও মুসলিমদের অবস্থা দেখে তা অনুমেয়। একতরফা চালানো সহিংসতায় চার লক্ষ মানুষ গৃহহীন হতে হয়েছিল। যেখানে আদিবাসী মহিলাদের উলঙ্গ করে দৌড় করানো ঘটনা ও ঘটেছে। গুজরাট ও দিল্লিতে দাঙ্গায় মুসলিম হত্যা করা হয়েছে। এন আর সির নামে ২০ লক্ষ মানুষকে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। দলিত ও মুসলিমদের সন্দেহবশত গেপ্তার করা হচ্ছে। তাই আমাদের প্রশ্ন ভারত যদি স্বাধীন হবে তবে ভারতবাসীর এমন দশা হবে কেন? তাই এই সমস্ত ঘটনাগুলি থেকে বোঝা যায় ভারতের স্বাধীনতা উচ্চবর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দলিত নির্যাতিত ও বঞ্চিত মুসলিমদের মধ্যে জোটবদ্ধ হয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা সময়ের দাবি।
পরিশেষে ডঃ আম্বেদকর এর ভাষায় বলি, "আমরা চাই সেই স্বাধীন ভারত যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের থাকবে সমান অধিকার, যখানে সামাজিক নিপীড়ন থাকবে না, অস্পৃশ্যতা যেখানে পাপ বলে বিবেচিত হবে এবং জন্মগত কারণে মানুষ মানুষকে ঘৃণা করবে না।"
0 Comments