সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে এসেছিল শেরে বাংলা কে ছিল?  দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর সম্পর্কে বেশিরভাগ পরীক্ষার্থীই অজ্ঞ। এই অজ্ঞতা দূর করার জন্যই আমার এই লেখনি। এছাড়াও  আমাদের দেশে এক অশুভ শক্তি আবার ও বাংলা ভাগ করার প্রয়াস চালাচ্ছে তাই শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের চর্চা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।


আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ফজলুল হক সম্পর্কে বলেন
“আমি রাজনীতির কথা বলছি না। আমি বলছি বাঙালি জাতির ভবিষ্যতের কথা। সমস্ত রাজনৈতিক সত্যের ওপর আর একটা বড় সত্য আছে। সেটা বাঙালি জাতির অস্তিত্ব। বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নির্ভর করে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ওপর। ফজলুল হক এই ঐক্যের প্রতীক। আমি কংগ্রেসীদের ভারতীয় জাতীয়তা বুঝি না। আমি বুঝি বাঙালির জাতীয়তা। এ জাতীয়তা প্রতিষ্ঠা করতে পারে একমাত্র ফজলুল হক। ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি মুসলমান। খাঁটি বাঙালিত্বের সঙ্গে খাঁটি মুসলমানের এমন অপূর্ব সমন্বয় আমি আর দেখি নি। ফজলুল হক ওই সমন্বয়ের প্রতীক। এ প্রতীক তোমরা ভেঙো না। ফজলুল হকের অমর্যাদা তোমরা করো না। আমি বলছি, বাঙালি যদি ফজলুল হকের মর্যাদা না দেয়, তবে বাঙালির বরাতে দুঃখ আছে”।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় শেরে বাংলা কে চিনে ছিল আমরা আজ ও তাকে চিনতে পারি নি।


বরিশালের মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৮৭৩ সালে  ২৬ শে অক্টোবর ফজলুল হক জন্মগ্রহণ করেন।  ১৮৮১ সালে আট বছর বয়সে ফজলুল বরিশাল জেলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। তখন ওই স্কুলের নিয়ম ছিল, নতুন ছাত্ররা ক্লাসে পিছনের বেঞ্চে বসবে। পরে পরীক্ষার ফল যাদের ভালো হবে, তারাই সামনের দিকে বসতে পারবে। শিশু ফজলুল প্রথম দিনই পিছনের বেঞ্চে বসতে অস্বীকার করেন। স্কুলের নিয়মের কথা জানানো হলে তিনি জেদ ধরেন, তাহলে আজই আমার পরীক্ষা নেওয়া হোক। বাধ্য শিক্ষকরা পরীক্ষা নেন। এবং তিনি সামনের বেঞ্চে বসার যোগ্যতা অর্জন করেন। 

ফজলুল হক ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের প্রতিভাবান ছাত্র। কিন্তু, প্রথমে এমএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি ভাষায়। পরীক্ষার মাত্র ছয় মাস আগে তাকে এক বন্ধু ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন যে, মুসলমান ছাত্ররা অঙ্ক নিয়ে পড়ে না, কারণ তারা মেধাবী নয়। এই কথা শুনে ফজলুল হকের প্রবল জেদ হয়। তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, অঙ্কশাস্ত্রেই পরীক্ষা দেবেন। এরপর, মাত্র ছয় মাস অঙ্ক পড়েই শেরে বাংলা প্রথম শ্রেণিতেই উত্তীর্ণ হন।


তারপর কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিএল পাশ করে স্যার আশুতোষ মুখার্জির শিক্ষানবিশ হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেন। দুই বছর কাজ করার পর ১৯০০ সালে তিনি সরাসরি আইন ব্যবসা শুরু করেন। হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করলে খুব তাড়াতাড়ি চারদিকে নাম ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে তার কথাবলার ধরনটা একটু অন্য রকম। বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে প্রচুর দেশীয় শব্দ ব্যবহার করে, আন্তরিকতা নিয়ে, সঙ্গে শ্লেষ জুড়ে এমন করে জমিয়ে দিতেন, যে সাধারণ মানুষ তো হতোই— বিচারপতিরা পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতেন।

আইন-পেশা ও ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার মানুষের সামাজিক মুক্তির কথাও ভেবেছেন তিনি। অনুভব করেন, সেমিনার বক্তৃতায় আগুন ঢেলে দিলে সাধারণ মানুষের শোষণ থেকে মুক্তি হবে না। কাজ করতে হবে। প্রান্তিক মানুষের জীবন কাছ থেকে দেখা ও নিজে মধ্য ঘরানার জমিদার হওয়ায় নিঃস্ব গরিব চাষিদের মর্মযাতনা অনুভব করতে পারতেন। অন্যদিকে তাকে উদ্দীপ্ত করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে অমানবিক আচরণ! দেখা যেত কৃষকশ্রেণি তাদের অত্যাচারে পিষ্ট, জমিদার সম্প্রদায়ের সরকারকে দেয় রাজস্ব, হাস্যকর নিচু জায়গায় বাঁধা, অথচ যে কৃষকশ্রেণি হাল টেনে বীজ বোনে, দিনরাত খাটুনি যায়, দিনরাত পরিশ্রমে ফসল ফলায়, তার ওপর জমিদারদের খাজনা অহেতুক বেড়েই চলে। আর খাজনা দিতে না পারলে জমি থেকে উৎখাত।

এইভাবে কারণে-অকারণে আতঙ্কে কৃষকরা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়, ঋণের বোঝা ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। অপরিশোধনীয় ঋণের পাহাড়, দরিদ্র কৃষকদের অনাহারে-অপুষ্টিতে দিনাতিপাত। সর্বোপরি কৃষিভিত্তিক বাংলার প্রাণ ছিল রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে ফসল ফলানো কৃষকেরা। কিন্তু, তাদেরকে প্রতিনিয়ত শোষণ করে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে একদল জমিদার আর মহাজন। তৎকালে এমন দৃশ্য চোখের পড়ার মতো। এ হতে পারেনা।
   ফজলুল হক ১৯১৫ সাল থেকে বরিশাল জেলার দলিত ও মুসলমান কৃষকদের সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর ধরে তিনি সারা বাংলার জমিদার মহাজনদের বঙ্গ কৃষক প্রজা পার্টি নামে এক রাজনৈতিক দল গঠন করেন।

 তিনি গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেছিলেন।  বিশেষ উল্লেখযোগ্য হকই কলকাতা কর্পোরেশনের প্রথম মুসলমান মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন  --- ১৯৩৫ সালে। নিয়তির কী অদ্ভুত পরিহাস, ১৯৪৭ এ বাংলাভাগের প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন হকসাহেব। এব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মেজদা তৎকালীন প্রাদেশিক কংগ্রেস সভাপতি শরৎচন্দ্র বসু এবং বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহিদ সোহরাবর্দিও। এরা তিনজনেই চেয়েছিলেন বাংলা অবিভক্ত থাক। অন্যদিকে, বাংলাকে খণ্ডিত করার পক্ষে সবচেয়ে সরব ও সক্রিয় ছিলেন হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি কে? স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র। যিনি প্রধানত ফজলুল হকের আগ্রহেই প্রথমবার মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পান। হাইকোর্টে একদা সিনিয়র ‘স্যারে’র প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই নাকি হকসাহেব শ্যামাপ্রসাদকে মন্ত্রী করেছিলেন। 

আবুল কাশেম ফজলুল হক ছিলেন সাধারণ মানুষের ও দরিদ্র কৃষকের অকৃত্রিম বন্ধু।  তিনি প্রথম বাংলায় 'দলিত ও মুসলিম ' সরকার গড়ে ছিলেন।হক সাহেব আজীবন হিন্দু - মুসলিম  সম্প্রতি স্থাপনে কাজ করেছেন।
  এই ক্ষণজন্মা পুরুষটির জন্ম না হলে  এবং এই অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য তিনি পিতৃদায়িত্ব পালন না করলে মুসলমানদের ঘরে জন্মগ্রহণ করে ও মুসলিমরা তেমন ভাবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার,  উকিল, মোক্তার জজব্যারিষ্টার,  শিক্ষক, প্রফেসর, উন্নতমানের লেখক, সাংবাদিক হতে পারতেন না।
  যে চারটি কাজের জন্য সকলের মনের মনিকোঠায় তিনি চিরদিন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তা হচ্ছে  ১. প্রজাস্বত্ব আইন ২. ঋণ সালিসি বোর্ড ৩. মুসলমান ছেলেমেয়েদের শিক্ষার উন্নয়ন এবং ৪. হিন্দু মুসলিম ঐক্য।
 গরীব, মেহেনতি, কৃষক প্রজাদের দুঃখ দুর্দশার কথা তিনি সর্বদা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অনুভব করতেন এবং কী ভাবে এই দুর্দশার কথা তিনি লাঘব করা যায়, তার উপায় উদ্ভাবনে সদা সচেষ্ট থাকতেন। ১৯২৯ সালে কৃষক - প্রজাদের দাবি - দাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি একটি সমিতি গঠন করেন এবং তার নাম দেন 'নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি' এবং এর দ্বারা তিনি কৃষকদের আন্দোলন এতটা জোরদার করে তোলেন যে জমিদার মহাজনগণ কৃষকদের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হন এবং জোর জুলুম করে কৃষকদের যেসব জমি দখল করে নিয়েছিলেন, তা ফেরত দিতে বাধ্য হন। 

 একটি আইন প্রনয়ন করে তিনি সারা বাংলার সকল গরিব প্রজাদের জীবন রক্ষা করেছিলেন,  যার ফলশ্রুতি 'ঋণসালিসি বোর্ড। যে বোর্ড বাংলার কয়েক কোটি চাষিকে মহাজনী ঋণের ফাঁস থেকে মুক্ত করেছিল। ‘লাঙ্গল যার, জমি তার’, ‘ঘাম যার, দাম তার’ প্রভৃতি ছিল তাঁর কৃষক প্রজা পার্টির তোলা আওয়াজ। তৎকালে সুদ ও চক্রবৃদ্ধি সুদের প্রভাব ও শোষণ এত বেশি ছিল যে, একবার যে কৃষক,  এই যাঁতাকলে আবদ্ধ হত, নিষ্পেষিত হওয়া ছাড়া তার আর বাঁচার কোন উপায় থাকতো না।  মহাজনগণ আগ্রহসহকারে কৃষকদের ঋণ দিত এবং সুদের হার ছিল অত্যন্ত বেশি। আর মহাজনী আইন এত শক্ত ছিল যে, নিদিষ্ট সময়ে সুদ পরিশোধ করতে না পারলে ঐ সুদটা আসলেন রূপান্তরিত হত এবং  এইভাবে সুদ বাড়তে বাড়তে কয়েক বছরের মধ্যে এত ঋণ জমা হয়ে যেত যে, ঐ কৃষকের পক্ষে আর ঐ টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হত না। ফলে যে জমিটা বন্ধক রেখে ঋণের টাকা গ্রহণ করত, ঐ জমিটাই নিলাম করে মহাজন নিয়ে নিত এবং এইভাবে কৃষক-প্রজারা একের পর এক জমি হারিয়ে একেবারে ভূমিহীন হয়ে পড়ত। এহেন পরিস্থিতিতে এই ক্ষণজন্মা পুরুষ শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হক আইন করে ঋণসালিসি বোর্ড গঠন করে দিয়ে  বাংলার কৃষককুলকে চরম ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। 


 শের এ বাংলা তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে,  এ দেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত,  নিষ্পেষিত,  অশিক্ষিত,  দরিদ্র,  দলিত শ্রেণী ও মুসলমানদের জাগ্রত করতে হলে, তাদের অশিক্ষার অন্ধকার থেকে উঠিয়ে এনে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করতে হবে। তাই শিক্ষার জন্য তিনি যে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন, এ জাতি তা চিরকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখতে বাধ্য। তিনি যখনই কোন মন্ত্রিত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তিনি কখনও নিজের হাতছাড়া করেন নি। আর এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে তিনি নানা কৌশলে অনুন্নত মুসলিম ছেলেমেয়েদের শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘঠিয়েছেন। ১৯২৪ সালের ৯ ই  ডিসেম্বর বাংলার গর্ভনর লর্ড লীটস, কলকাতায় 'ইসলামিয়া কলেজের ' ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ নামে পরিচিত। শুধু তাই নয়,  তাঁরই মন্ত্রীত্ব কালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি নতুন পদের ও সৃষ্টি হয়। যার নাম হয় অ্যাডিশনাল ডাইরেক্টর ফর মুসলিম এডুকেশন। 

তাঁর সাহস ও বাগ্মীতায় মুগ্ধ হয়ে ১৯৩৭ সালে লখনউয়ের নাগরিক সমাজ ফজলুল হককে ‘শের ই বাংলা’ উপাধিতে ভূষিত করেন।