পরিবার হল সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ।  শত শত পরিবার নিয়েই গঠিত হয় একটি সমাজ। তাই পরিবার পরিবর্তন এর  মধ্যদিয়েই সমাজের পরিবর্তন আসে। আজ আমাদের সমাজে সর্বত্রই অশান্তির দাবানল লেগে রয়েছে। তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে সমাজের বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীকে। বিশেষকরে নারী সমাজ আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। খুন ইভটিজিং ধর্ষণ, গণধর্ষণ, কণ্যা ভ্রণ হত্যা প্রভৃতি নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। পণ প্রথার নামে চলছে নারী নির্যাতন। শিশু, যুবকরা আজ নানান নেশাদ্রব্য জিনিষে যুক্ত। তাদের মধ্যে বড়কে সম্মান করা ও ছোটদের স্নেহ করার মানসিকতা হারিয়ে যাচ্ছে । জ্ঞান চর্চা বাদ দিয়ে তারা  নানান অপসংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছে। 



 সমাজে সর্বত্রই চলছে  দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার। দেখা দিচ্ছে মানুষ মানুষের প্রতি ভালোবাসা  ও সহমর্মিতার অভাব। তৈরি হয়েছে ক্ষুদ্র স্বার্থের বেড়া। বৃদ্ধ মানুষরা আজ আমাদের সমাজের কাছে বোঝা।গড়ে  উঠছে একাধিক বৃদ্ধাশ্রম।সমাজে মানুষের নৈতিকতার অভাব প্রকট হয়ে উঠছে।



এই সবের মূলে আছে আমাদের পরিবারের ভূমিকা।  আমরা টেলিভিশন ও নেট দুনিয়ার মাধ্যমে পশ্চিমা ও ব্রাহ্মন্যবাদী সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ করে চলেছি । তাই আমাদের পরিবারে স্বামী স্ত্রী  মধ্যে ভালোবাসা কমে যাচ্ছে। বিবাহিত নারী ও  পুরুষরা পরকিয়ার মত ঘৃণ্য ব্যবস্থায় জড়িয়ে পড়ছে। ফলে বৈবাহিক বিচ্ছেদের ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে।  আমাদের পারিবারিক সিস্টেম  ভেঙে যাচ্ছে। শিশুরা মাতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অপর দিকে পরিবারে শিশুদের সঠিক ভাবে গড়েতোলার সদিচ্ছার অভাব দেখাদিচ্ছে। তাই তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবনতা বেড়ে চলেছে। এই সমস্ত শিশুরা বড় হয়ে সমাজে বিশৃঙ্খল সৃষ্টি করছে।

সুসংহত পরিবার গঠন করার উপায়
______________________________
পবিত্র কুরআন এ মহান আল্লাহ তাওয়ালা বলেন

হে লোকজন যারা ঈমান এনেছো, তোমরা নিজেদেরকে এবং নিজেদের পরিবার ও সন্তান-সন্ততিকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করো মানুষ এবং পাথর হবে যার জ্বালানী।  
(৬৬: আত-তাহরীম:৬,)

পবিত্র কুরআন এর ঘোষণা অনুযায়ী নিজেদের এবং নিজ পরিবার কে জাহান্নামের আগুনের হাত থেকে রক্ষা করার তাগিদ দিয়েছেন। পরিবার পরিবর্তন আগে পরিবারের কর্তার পরিবর্তন এর প্রয়োজন আছে।  কারণ পরিবারের কর্তায় পরিবারকে পরিচালনা করে থাকেন। তাদের দায়িত্ব কর্তব্য আছে। মহানবী সঃ বলেছেন জেনে রাখো, তোমাদের প্রত্যেকেই একেকজন দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। ...একজন পুরুষ তার পরিবার (স্ত্রী-সন্তানদের) উপর দায়িত্বশীল। সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।" [সহিহ মুসলিম]


 তাই সর্ব প্রথম পরিবারের কর্তা এবং তার সহযোগী স্ত্রীকে কুরআন ও হাদীসের  আলোয় নিজেদের  আলোকিত করে গড়ে তুলতে হবে। স্বামী স্ত্রী মধ্যে ভালোবাসা ও সহোযোগিতার মাধ্যমে পরিবার পরিচালনা করতে হবে। উভয়কেই তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে। তাহলে স্বামী স্ত্রী উভয়ই তাদের অধিকার পেয়ে যাবে। মহান আল্লাহর ঘোষণা 

" নারীদের জন্যও ঠিক তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে যেমন পুরুষদের অধিকার আছে তাদের ওপর।"
(২: আল-বাক্বারাহ:২২৮,)

, ‘‘তারা (স্ত্রী)তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক।’’( সূরা বাকারা ১৮৭)

মহানবী (সঃ) বলেছেন, তোমরা স্ত্রীদের জন্য মঙ্গলকামী হও (বুখারী ৩৩৩১, মুসলিম ৪৭)

•মহানবী (সঃ)  বলেছেন, তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সবচেয়ে উত্তম যে তার স্ত্রীদের কাছে উত্তম (তিরমিজি ১১৬২)

স্বামী স্ত্রী উভয় কে তাদের  সন্তানদের কুরআন ও হাদীসের আলোকে সৎ ও চরিত্রবান ও আল্লাহ ভিরু হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। বাড়িতে কুরআন ও হাদীস ও ইসলামি সাহিত্য চর্চার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।অপসংস্কৃতির হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে হবে। সন্তান সন্তুতিদের চরিত্র রক্ষায় হজরত লুকমান এর উপদেশ গুলি খুবই উপযুক্ত। আমাদের সন্তানদের জন্য সূরা লুকমানের আয়াত গুলির মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে।

৩১: লুকমান:১৩,
স্মরণ করো যখন লুকমান নিজের ছেলেকে উপদেশ দিচ্ছিল, সে বললো, “হে পুত্র! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না।  যথার্থই শিরক অনেক বড় জুলুম।

৩১: লুকমান:১৪,

আর প্রকৃতপক্ষে আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার হক চিনে নেবার জন্য নিজেই তাকিদ করেছি। তার মা দুর্বলতা সহ্য করে তাকে নিজের গর্ভে ধারণ করে এবং দু’বছর লাগে তার দুধ ছাড়তে। (এ জন্য আমি তাকে উপদেশ দিয়েছি) আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং নিজের পিতা-মাতার প্রতিও, আমার দিকেই তোমাকে ফিরে আসতে হবে।

৩১: লুকমান:১৫

কিন্তু যদি তারা তোমার প্রতি আমার সাথে এমন কাউকে শরীক করার জন্য চাপ দেয় যাকে তুমি জানো না, তাহলে তুমি তাদের কথা কখনোই মেনে নিয়ো না। দুনিয়ায় তাদের সাথে সদাচার করতে থাকো কিন্তু মেনে চলো সে ব্যক্তির পথ যে আমার দিকে ফিরে এসেছে। তারপর তোমাদের সবাইকে ফিরে আসতে হবে আমারই দিকে। সে সময় তোমরা কেমন কাজ করছিলে তা আমি তোমাদের জানিয়ে দেবো। 

৩১: লুকমান:১৬,

(আর লুকমান বলেছিল) “হে পুত্র! কোন জিনিস যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা লুকিয়ে থাকে পাথরের মধ্যে, আকাশে বা পৃথিবীতে কোথাও, তাহলে আল্লাহ‌ তা বের করে নিয়ে আসবেন। তিনি সূক্ষ্মদর্শী এবং সবকিছু জানেন।

৩১: লুকমান:১৭,

হে পুত্র! নামায কায়েম করো, সৎকাজের হুকুম দাও, খারাপ কাজে নিষেধ করো এবং যা কিছু বিপদই আসুক সেজন্য সবর করো। একথাগুলোর জন্য বড়ই তাকিদ করা হয়েছে। 

৩১: লুকমান:১৮,
আর মানুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কথা বলো না, পৃথিবীর বুকে চলো না উদ্ধত ভঙ্গিতে, আল্লাহ‌ পছন্দ করেন না আত্মম্ভরী ও অহংকারীকে।


৩১: লুকমান:১৯,

নিজের চলনে ভারসাম্য আনো এবং নিজের আওয়াজ নীচু করো। সব আওয়াজের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে গাধার আওয়াজ।

এই উপদেশগুলির মাধ্যমে  যদি আমরা আমাদের সন্তানদের তৈরি করতে পারি তাহলে সুসংহত পরিবার গঠন সম্ভব হয়ে উঠবে।

সু সংহত সমাজ গঠনের উপায়ঃ

একাধিক সংখ্যাক সুসংহত পরিবার গঠন  হলেই তবেই সুসংহত সমাজ গঠন সম্ভব হবে। তবে যদি কিছু পরিবার সুসংহত হয়। আর একাধিক পরিবার বিপন্ন থাকে তাহলে মোমিন নারী ও পুরুষদের অন্যন্যা পরিবারকে কে সুসংহত করার লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা করে যেতে হবে। 
আল্লাহ মূল দায়িত্ব নারী-পুরুষের একই দিয়েছেন । সুরা তওবার ৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,

 

নারী পুরুষের দায়িত্ব ছয়টি:

 

১. তারা ভালো কাজের আদেশ দেবে।

২. মন্দকাজের ব্যাপারে নিষেধ করবে।

৩. উভয়ে নামাজ কায়েম করবে।

৪. জাকাত দেবে।

৫. আল্লাহকে মানবে।

৬. রাসূল (সা.)-কে মানবে।

আয়াতটিতে আরো বলা হয়েছে
মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারী একে অপরের অভিভাবক (ওয়ালি), একে অপরের বন্ধু, একে অপরের সাহায্যকারী (সুরা আত তওবা, ৯: ৭১)।

জবাবে তাদের রব বললেনঃ “আমি তোমাদের কারো কর্মকাণ্ড নষ্ট করবো না। পুরুষ হও বা নারী, তোমরা সবাই একই জাতির অন্তর্ভুক্ত। 
(৩: আলে-ইমরান:১৯৫,)

 মহান আল্লাহ আর বলেন

সেই ব্যক্তির কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হবে যে আল্লাহ‌র দিকে ডাকলো, সৎ কাজ করলো এবং ঘোষণা করলো আমি মুসলমান।
(৪১: হামীম-আস-সাজদাহ:৩৩,)

এই ভাবে সুসংহত পরিবার গুলি সংঘবদ্ধভাবে দাওয়াতি কাজ ও সৎকর্মের  মাধ্যমে সুসংহত সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা করে যেতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন

এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম দল। তোমাদের কর্মক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের হিদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য। তোমরা নেকীর হুকুম দিয়ে থাকো, দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহ‌র প্রতি ঈমান আনো।
(৩: আলে-ইমরান:১১০,)

তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক অবশ্যই থাকতে হবে, যারা নেকী ও সৎকর্মশীলতার দিকে আহবান জানাবে, ভালো কাজের নির্দেশ দেবে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তারাই সফলকাম হবে।
(৩: আলে-ইমরান:১০৪,)

কুরআনের এই আয়াতগুলি আমাদের সংঘবদ্ধভাবে সুসংহত সমাজ গঠনের নির্দেশ দেয়। তাই একজন মোমিনের প্রধান কাজ নিজে সংশোধিত হয়ে সুসংহত পরিবার গঠন করা, তারপর সুসংহত সমাজ গঠন করা। যে সমাজে থাকবে না দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার। থাকবে না ঘৃণা, বিদ্বেষ, ক্ষুণ, ধর্ষণ, গণধর্ষণ। যে সমাজে থাকবে ছোট বড় কে সম্মান করা । বড় ছোটদের স্নেহ করা। যেখানে নারী শিশু বৃদ্ধদের থাকবে নিরাপত্তা। হবে অশ্লীলতা মুক্ত। যেখানে থাকবে মানব প্রেম। থাকবে না কোন অপসংস্কৃতি ছোঁয়া। থাকবে মানবাধিকার সমানাধিকার, সুবিচার।