দেবাশিস ভট্টাচার্য
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যাদের অবদান চির অম্লান, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন দুই আলি ভাই - মাওলানা শওকত আলি ও মুহাম্মদ আলি। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের সময় মহম্মদ আলী, মহাত্মা গান্ধীর অন্যতম সহযোগী হয়ে উঠেছিলেন। অনেকে এই কনিষ্ঠ আলি ভাইকে গান্ধিজীর ভাবশিষ্য বলতে দ্বিধা করতেন না। পরবর্তীতে এই দুই ভাই আলীগড় আন্দোলন সহ অন্যান্য অনেক সংগ্রামের যোগ্য নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে একই সঙ্গে তাঁদের বীরজননী 'বি আম্মা' নামে আপামর ভারতবাসীর কাছে পরিচিত আবাদি বানু বেগম ও যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যোগ্য সঙ্গত দিয়ে গেছেন, একথা কিন্তু আমাদের অনেকেরই অজানা। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের সেই উত্তাল সময়ে ভারতীয় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে বি আম্মা প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন।
তৎকালীন যুক্তপ্রদেশের রোহিলাখণ্ড বিভাগের অন্তর্গত ক্ষমতাশালী সামন্ত রাজ্য রামপুরের এক খানদানি পরিবারের সন্তান ছিলেন আলি ভায়েদের পিতা মৌলবী আবদুল আলি খান। রামপুরের নবাব ইউসুফ আলী খানের অত্যন্ত স্নেহভাজন বি আম্মার মরহুম স্বামী নবাব সরকারের এক উচ্চপদে আসীন থাকাকালীন ১৮৮০ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে কলেরা রোগে ইন্তেকাল করেন। বি আম্মার পূর্ব পুরুষ দরবেশ আলী খান ছিলেন সম্রাট আকবরের এক বিশিষ্ট ওমরাহ এবং পাঁচ হাজারী মনসবদার। পিতৃপুরুষের বিশ্বস্ততা ও বুদ্ধিমত্তার পূর্ণ অধিকার তিনি পেয়েছেন। আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য ও স্থির দৃষ্টিসমন্বিত তিন গুণে ভূষিতা ছিলেন তিনি। মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি স্বামীকে হারান। তবে অল্প বয়সে স্বামীহারা হয়েও বি আম্মা ছেলেদের শিক্ষাদানের ব্যাপারে কোন ও ফাঁদ এবং পুনর্বিবাহের একাধিক প্রস্তাব প্রত্যাখান করে যত্ন নেন সন্তান প্রতিপালনে। উর্দূ, ফারসি আরবি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে গোপনে নিজের গয়না বিক্রি করে ছেলেদেরকে রামপুর থেকে চল্লিশ মাইল দূরবর্তী বেরিলীর ইংরাজি বিদ্যালয়ে পাঠান শিক্ষা দেবার জন্য। বলা বাহুল্য মায়ের লক্ষ্যকে সফল করে তুলেছিলেন শওকত ও মহম্মদ দুজনেই। শওকত ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাজুয়েট, আর মুহাম্মদ ১৮৯৬ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় সমগ্র যুক্তপ্রদেশে বি এ পরীক্ষায় প্রথম হন। পরে রামপুরের নবাবের সহযোগিতায় আইসিএস হবার লক্ষ্যে বিলেত যান। দুর্ভাগ্যক্রমে অল্পের জন্যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হন তিনি। এ সময় আম্মার আর্থিক অবস্থাও স্বচ্ছল ছিল না। এজন্য বিলেত থেকে দেশে ফিরে শওকত আলি ইংরেজ সরকারের অধীনে উচ্চপদে যোগ হন আর মহম্মদ আলি আসীন হন বরোদা রাজ্যের বিচার বিভাগে।
রাজনীতি ক্ষেত্রে কংগ্রেস তখন ধীরে ধীরে বৃহত্তর আন্দোলনে নামার অঙ্গীকার নিচ্ছে। আগামী দুরবস্থার তোয়াক্কা না করে এ সময় আম্মা পুত্রদের দেশমুক্তির সংগ্রামে ডাক দেন। মায়ের সম্মতিতে উচ্চপদের লোভনীয় বেতন ত্যাগ করে শওকত ও মুহাম্মদ আলি দেশসেবায় ব্রতী হলে ভারতীয় ইতিহাসে এক নতুন প্রেক্ষাপট গড়ে ওঠে। মুসলিম তথা ভারতীয় জনগণের মধ্যে তাদের প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকায় ১৯১৫ সালের ১৫ ই মে জুম্মার দিনে সরকার আলি ভাইদের বন্ধি করে দিল্লি থেকে ১১ মাইল দূরে মরাউনী গ্রামে স্থানান্তরিত করে। এরপর প্রহসনের বিচারে ৭ বছরের জেল হয় দুজনের। মুচলেকা দিয়ে মুক্তির প্রস্তাব ও প্রত্যাখান করেন দু ভাই। আলি ভাইদের কারাবন্দীত্বের এ সময় আম্মা একাই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
১১১৭ কংগ্রেসের অধিবেশন বসে কলকাতায়। সভানেত্রীর পদ অলংকৃত করেন থিয়োসফিক্যাল সোসাইটি ও হোমরুল আন্দোলনের অগ্রনায়িকা ও সদ্য কারামুক্ত অ্যানি বেসান্ত। অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি বহরমপুরের আইনজীবী বৈকুন্ঠনাথ সেন। এই সভায় অংশ নিয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিন পাল, এ কে ফজলুল হক, সি আর দাশ, তিলক মালব্য, মোহনদাস গান্ধী, যুমনা দাস, দ্বারকা দাস, সত্যমূর্তিসহ বাংলা তথা ভারতের দিকপাল নেতৃবৃন্দ।
এছাড়া জাতীয় কংগ্রেসের কোনও অধিবেশনে প্রথমবারের মতো স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী নিয়ে উপস্থিত ছিলেন বি আম্মা। এই সভায় আম্মা একটি সংক্ষিপ্ত মনোজ্ঞ ভাষণ দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। ব্যক্তিগত জীবনে আম্মা বাস্তবিকই নিপীড়িত মানুষের দুর্দিনের সাথী হয়ে উঠেছিলেন। ঐক্য ও সম্প্রতির অগ্রদূত এই বীর রমনীর ১৯২৪ সালের শেষ দিকে স্বাস্থ্যের ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। সে বছর ১২ নভেম্বর প্রিয় দেশের মায়া কাটিয়ে ইন্তেকাল করেন তিনি। অমৃতসরের পুরনো এক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান নিঃসন্দেহে চির অমলিন থাকবে।
0 Comments