[পর্ব-০৪]
~~ ড. আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল
ভারতের মধ্যে মুসলিম ভারত
সুতরাং ভারতের মতো দেশে এক ঐক্যবদ্ধ সামগ্র্য গঠনের জন্য উচ্চতর বৈশিষ্ট্য-সহকারে সাম্প্রদায়িকতা অপরিহার্য। ভারতীয় সমাজের ইউনিটসমূহ ইউরোপীয় দেশসমূহের মতো আঞ্চলিক নয়। ভারত বিভিন্ন ভাষাভাষী ও বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী বিভিন্ন মানব-সমষ্টির সমন্বয়ে গঠিত এক মহাদেশ। তাদের আচরণ এক সাধারণ বর্ণ-চেতনা (race consciousness) দ্বারা মোটেই নির্ধারিত নয়। এমনকি, হিন্দুরাই এক সমজাতীয় গোষ্ঠী গড়ে তোলেনি। সাম্প্রদায়িক দলসমূহের অস্তিত্ব স্বীকার না করে ভারতে ইউরোপীয় গণতন্ত্রের নীতি প্রয়োগ করা যেতে পারে না। সুতরাং ভারতের ভিতরে এক মুসলিম ভারত গড়ে তোলার জন্য উত্থাপিত মুসলিম দাবী সম্পূর্ণ যুক্তিসংগত। আমার মতে, দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় মুসলিম সম্মেলনের (All Parties Muslim Conference) গৃহীত প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে এক ঐক্যবদ্ধ সামগ্র গঠনেরই মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং তা তার অন্তর্গত বিভিন্ন সমগ্র দল নিজ নিজ সত্তাকে বাধাগ্রস্ত করার পরিবর্তে বরং তাদের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে পূর্ণ বিকশিত করার পরিপূর্ণ সুযোগ তাদেরকে দেবে। এই সভা উক্ত প্রস্তাবে বিধৃত মুসলিম দাবীসমূহ জোরের সাথে সমর্থন করবেন, সে সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
ব্যক্তিগতভাবে আমি উক্ত প্রস্তাবে বিধৃত দাবীসমূহের চাইতেও কিছুতা বেশী অগ্রসর হতে চাই। আমি পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানকে একটি একীভূত রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই। বৃটিশ সাম্রাজ্যের ভিতরে অথবা বৃটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে স্বায়ত্তশাসন, এক ঐক্যবদ্ধ উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় মুসলিম রাষ্ট্রগঠন, আমার কাছে মুসলমানদের, অন্ততঃ উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলমানদের চূড়ান্ত ঠিকানা বলে মনে হয়। প্রস্তাবটি নেহরু কমিটির সামনে পেশ করা হয়েছিলো। এই প্রস্তাব কার্যকরী হলে তা হবে পরিচালনার অনুপযোগী একটি রাষ্ট্র এই যুক্তিতে তারা প্রস্তাবটি অগ্রাহ্য করেছিলেন। আয়তনের দিক বিবেচনা করলে এ কথা সত্য; জনসংখ্যর দিক দিয়ে এই প্রস্তাবে পরিকল্পিত রাষ্ট্র বর্তমানের কোনো কোনো ভারতীয় প্রদেশ অপেক্ষাও ছোট হবে। আম্বালা বিভাগ ও সম্ভবতঃ অমুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ কতিপয় জেলার বহির্ভূক্তি তাকে পরিধির দিক দিয়ে আরো অল্প পরিসর ও অধিকতর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ করবে, এবং তার ফলে এই নবগঠিত রাষ্ট্র তার এলাকার মধ্যে অমুসলিম সংখ্যালঘুদেরকে কার্যকরীভাবে সংরক্ষণের অধিকতর সামর্থ্য লাভ করবে। এই ধারণায় হিন্দু বা বৃটিশ জনগণের কোনরূপ আতঙ্কের কারণ নেই। ভারত পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দেশ। এ দেশে সাংস্কৃতিক শক্তি হিসাবে ইসলামের জীবন সব চাইতে বেশী করে নির্ভর করে তাকে এক নির্দিষ্ট অঞ্চলের কেন্দ্রীভূতকরণের উপর। ভারতীয় মুসলিমদের সর্বাধিক অংশের এই কেন্দ্রীভূতকরণে ভারতের ও এশিয়ার সমস্যার সমাধান হবে। বৃটিশ সরকারের অসংগত আচরণ সত্ত্বেও যাদের সামরিক ও পুলিশ বিভাগের চাকুরী দ্বারা এ দেশে বৃটিশ শাসন চালু রাখা সম্ভব হয়েছে। এ কেন্দ্রীভূতকরণের ফলে তাদের দায়িত্ববোধ তীব্রতর হবে এবং তাদের দেশাত্ববোধের মনোভাব প্রবলতর হবে।
এমনি করে ভারতীয় রাষ্ট্রের ভিতরে পূর্ণ আত্মবিকাশের সুবিধা লাভ করলে উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় মুসলিম বিদেশী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষক বলে প্রমাণিত হবে, সে হামলা আদর্শিক হোক অথবা বেয়নেটেরই হোক। শতকরা ৫৬ ভাগ মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে পাঞ্জাব ভারতীয় সামরিক বাহিনীর শতকরা ৫৪ ভাগ লোক সরবরাহ করে থাকে এবং নেপালের স্বাধীন রাষ্ট্র থেকে নিযুক্ত ১৯ হাজার গুর্খাকে বাদ দিলে পাঞ্জাবী সৈন্যদের সংখ্যা দাঁড়ায় সমগ্র ভারতীয় সামরিক বাহিনীর শতকরা ৬২ ভাগ। এই শতকরা হারের মধ্যে ভারতীয় সামরিক বাহিনীতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্থান থেকে সংগৃহীত প্রায় ছয় হাজার সশস্ত্র সৈন্যকে ধরা হয়নি। বৈদেশিক হামলা থেকে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় মুসলিমদের সম্ভাবনার হিসাব এ থেকে আপনারা সহজেই করে নিতে পারেন। রাইট অনারেবল মিঃ শ্রীনিবাস শাস্ত্রী মনে করেন, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকায় স্বায়ত্তশাসিত মুসলিম রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য মুসলিমদের এই দাবীর পশ্চাতে রয়েছে ‘জরুরী অবস্থায় ভারত সরকারের উপর চাপ দেবার উপায় অর্জনের জন্য’ তাদের ইচ্ছা। আমি তাঁকে স্পষ্টভাবে বলতে পারি, তিনি যে ধরনের উদ্দেশ্য আমাদের প্রতি আরোপ করেন, মুসলিম দাবী তা থেকে উদ্ভূত নয়; এর মূলে রয়েছে অবাধ আত্মবিকাশের অকৃত্তিম আকাঙ্ক্ষা, যা সমগ্র ভারতের উপর স্থায়ী সাম্প্রদায়িক আধিপত্য লাভের উদ্দেশ্যে জাতীয়তাবাদী হিন্দু রাজনীতিকদের পরিকল্পিত ইউনিটারী ধরনের শাসনব্যবস্থায় প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব।
হিন্দুদের এরূপ কোনো ভয়ের কারণ নেই যে, স্বায়ত্তশাসিত মুসলিম রাষ্ট্র সৃষ্টির অর্থ হবে এইরূপ রাষ্ট্রে এক ধরনের ধর্মীয় শাসন প্রবর্তন। ইসলামের ক্ষেত্রে এই ধর্ম শব্দটি যে অর্থে প্রয়োগ করা যেতে পারে, তা আমি এর আগেই আপনাদেরকে বলেছি। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম কোনো যাজকতন্ত্র নয়। এ হচ্ছে রুশোর এ ধরনের চিন্তা করার বহুপূর্বে চুক্তিবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা হিসাবে পরিকল্পিত এক রাষ্ট্র এবং তা এমন এক নৈতিক আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত, যাতে মানুষকে বিশ্বের কোনো বিশেষ অংশের দ্বারা পরিচিত ভূমিকেন্দ্রিক প্রাণী (Earth-rooted creature) হিসাবে ধরা হয় না, বরং তাদেরকে ধরা হয় সামাজিক সংগঠনের (Social Mechanism) নীতি অনুয়ায়ী আত্মিক সত্তা হিসাবে এবং সে সংগঠনের জীবন্ত অংশ হিসাবে তার অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারিত রয়েছে। কিছুকাল আগে ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ ভারতীয় ব্যাংকিং ইনকুয়ারী কমিটি সম্পর্কে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে যা বলেছিলেন, তা থেকে মুসলিম রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিচার করা যেতে পারে। পত্রিকাটিতে উল্লেখ করা হয়েছিলো: “In ancient India, the State framed laws regulating the rates of interest, but in Muslim times, although Islam clearly forbids the realization of interest on money loaned, Indian Muslim States imposed no restriction on such rates.” – “প্রাচীন ভারতে রাষ্ট্র সুদের হার নিয়ন্ত্রিত করে আইন প্রণয়ন করতো, কিন্তু ইসলামে ঋণ হিসাবে নিয়োজিত অর্থের সুদগ্রহণ সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ হলেও ভারতীয় মুসলিম রাজ্যসমূহ এইরূপ হারের উপর কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে নি।” সুতরাং আমি ভারতের ও ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থেই একটি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবী জানাচ্ছি। ভারতের পক্ষে এর ফলে সম্ভব হবে অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার ভারসাম্য বিধান করে নিরাপত্তা ও শান্তি কায়েম করা। আর ইসলাম এতে আরব সাম্রাজ্যবাদের ছাপ থেকে মুক্তি লাভের এবং তার কানুন, তার শিক্ষা ও তার সংস্কৃতিকে সুসংহত করে তার নিজস্ব বুনিয়াদী ভাবধারা ও আধুনিক কালের ভাবধারার সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ বিধানের সুযোগ পাবে।
{ সূত্র: ইকবাল একাডেমি করাচী থেকে প্রকাশিত সৈয়দ আব্দুল মান্নান সম্পাদিত ‘পাকিস্তানের ঐতিহাসিক পটভূমিকা’ গ্রন্থ (সংশোধিত এবং পরিমার্জিত) }
0 Comments