গোলাম রাশিদ
শিল্পপতি, সমাজ-চিন্তক মোস্তাক হোসেনকে নিয়ে লেখা গ্রন্থ পড়তে পড়তে বারবার মনে হবে রবীন্দ্রনাথের এই লাইনগুলি ---চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,/জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর/আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী/বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি। অমর্ত্য সেন যখন সেই বই পড়েন, তখন তা দেখে এই পঙক্তিগুলি যেন আরও অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে।
একবার নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল---আপনার বাড়ি কোথায়? বিশ্বের ঠিক কোন জায়গাটাকে নিজের ঘর বলে মনে হয় আপনার? জবাবে প্রফেসর সেন জানিয়েছিলেন, জগতজুড়েই তাঁর বাড়ি। বিশ্বকে তিনি আপন করে নিতে পেরেছেন। তাই তিনি বিশ্বজয়ী অর্থনীতিবিদ। শিল্পপতি, সমাজ-চিন্তক মোস্তাক হোসেনকে নিয়ে লেখা ‘উদার আকাশ’ থেকে প্রকাশিত ‘মোস্তাক হোসেন: জীবন ও ঐতিহ্য’ বইটি যখন ড. অমর্ত্য সেনের হাতে দেখলাম একটি ছবিতে, তখন ঠিক এই কথোপকথনটিই মনে ভেসে এল। আর দু’জনের মধ্যে এক অদ্ভুত মিল দেখতে পেলাম। একজন অর্থনীতি বিশারদ, আরেকজন ব্যবসা বিশারদ। দু-জনের কাজই অর্থ-সংক্রান্ত। দু-জনেই আকাশ ছুঁয়েছেন। বিশ্বজোড়া তাঁদের নাম। ভারতের শিল্প জগতের মানুষ আজ মোস্তাক হোসেনকে কুর্নিশ জানায়। জাতি-ধম-নির্বিশেষে সবার কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন, কাছের মানুষ হয়ে উঠেছেন, ভরসার স্থল হয়ে আশা জোগাচ্ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে। অর্মত্য সেন যেমন বাঙালি আইকন থেকে বিশ্ব আইকনে পরিণত হয়েছেন, তেমনই মুর্শিদাবাদের এক গ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করা মোস্তাক হোসেনও শিল্প, নির্মাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নিজের স্বাক্ষর সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। যারা বলেন বাঙালি ব্যবসা বোঝে না, বাঙালি চাকরি করে শুধু, তাদের সপাট জবাব দিয়ে মোস্তাক হোসেন আপন প্রতিভাবলে হিন্দু-মুসলিম-জৈন-খ্রিস্টান সবার কাছে এক মাইলস্টোন হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাই অমর্ত্য সেন যখন মোস্তাক হোসেনকে নিয়ে লেখা সমৃদ্ধ বইটিতে চোখ বোলান, তখন মনে হয়ে এ যেন দুই মহারথীর সাক্ষাৎ। এর চেয়ে ভালো আর কি বা হতে পারে। সমাজের মানুষের জন্য এই দু-জন নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন, সবসময় মানুষের পাশে থেকেছেন, এখনও থাকছেন।
এ বছরের আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় সাতশো কুড়ি পৃষ্ঠার এই গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কলম ধরেছেন একশো সতেরো জন লেখক। মূল্যবান গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন উদার আকাশের সম্পাদক-প্রকাশক ফারুক আহমেদ। কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘মোস্তাক হোসেনের জীবনমুখী কার্যকলাপের কথা জেনে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছি। তাঁর মতো মানুষ বিরল। এই যুগে এমন মানুষ কমই দেখা যায়। এমন জীবনদরদী ও মানবদরদী মানুষ এখন আমাদের খুব দরকার।’ কবীর সুমন, তপন মিত্র, অশোক দাশগুপ্ত, মইনুল হাসান, আহমদ হাসান ইমরান, সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়, খাজিম আহমেদ, সুরজিৎ দাশগুপ্ত, এমদাদুল হক নূর, জয়ন্ত ঘোষাল, সুমন ভট্টাচার্য, দেবাশিস পাঠক, জয়ন্ত সিংহ, সাহানা নাগ চৌধুরী, হারাধন চৌধুরী, সুধাংশু শেখর দে, অমর পাল, সাবির আহমেদ, মৌসুমী বিশ্বাস প্রমুখ সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিশিষ্টজনেরা গুরুত্বপূর্ণ লেখা দিয়ে গ্রন্থটি সমৃদ্ধ করেছেন। বিভিন্নজন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন জনাব মোস্তাক হোসেনকে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থা যখন ধ্বস্ত, আশাহীনতা যখন অন্ধকারের মতো কালো, সেই প্রেক্ষাপটে উত্থান ঘটেছিল মোস্তাক হোসেনের। শিল্পপতি, শিক্ষাব্রতী। সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে এক অদম্য সিপাহসালার। তিনি কি অনেক সম্পদের অধিকারী ছিলেন জন্মসূত্রেই? তাঁর নিজস্ব বর্ণনাতেই শোনা যাক সেই কথা, ‘জমিদার নয়। জোতদারও নয় আমাদের পরিবার। কিন্তু বিস্তর জমিজমার মালিক ছিলেন আমার দাদু ও তাঁর পূর্বপুরুষেরা। দেশভাগে যেমন বাংলা খণ্ডিত, তেমনিই বাংলার নদীও বিভক্ত। লক্ষ লক্ষ মানুষ যেমন বাস্তুচ্যুত হয়ে জমিজমা হারাল, আমরাও তেমনি ভাগ হয়ে গেলাম। আমাদের বহু স্বজন রাতারাতি বিদেশি রাষ্ট্রের বাসিন্দা হয়ে গেলেন। বাড়ির কাছে, যে নদীতটের আগে কোনো রাষ্ট্রীয় পরিচয় ছিল না, তা কোথাও ভারতীয়, কোথাও পাকিস্তানি বনে গেল। যে জমি আমার বাপঠাকুরদার বেঁচে থাকার ভরসা ছিল, তার বড় অংশ, অন্তত ২০০ বিঘা, পাকিস্তানের রাজশাহী জেলার সম্পত্তি বলে আচমকা হাতছাড়া হয়ে গেল। আরেক বড় অংশ নদীগর্ভে তলিয়ে গেল। দেশভাগের আগে মুর্শিদাবাদের বাড়ির আশেপাশের জমির ওপর নির্ভর করেই আমাদের সংসার চলত। ছোটোবেলায় চার চাচার যৌথ সংসারে খাবার দাবারের অভাব ছিল না হয়তো, পোশাক-আশাকও জুটতো। কিন্তু কখনো-সখনো অনটনও অনুভব করেছি। দেশভাগ আর নদীর গ্রাস এর প্রধান কারণ। কারও বসবাসস্থল এপারে, তো চাষবাস জমি সব ওপারে। এক দুর্বিষহ অতর্কিত অবস্থা। স্কুল কলেজ নেই। প্রশাসন নেই। নেই বেঁচে থাকার সংস্থান।... অসংখ্য নেই থেকে, বৃহত্তর শূন্যতা থেকে জীবনযুদ্ধ শুরু করেছিল আমার জেলা, আমার জন্মাঞ্চল।’
একজন মানুষের সফলতার মাপকাঠি কী? জীবনে তিনি কত অর্থবিত্ত আয় করতে পারলেন, নাকি তাঁর ‘অর্জিত’ মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বই আসলে সফলতা? এ নিয়ে বিদ্বজ্জনেরা বিতর্ক-সমালোচনার আসর বসাতে পারেন। কিন্তু দুটোকেই যদি সাফল্যের মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয় তবে তাতেও সসম্মান উত্তীর্ণ হবেন মোস্তাক হোসেন। দেশের বাঁটোয়ারা ও স্বাধীনতার ১০ বছর পর মুর্শিদাবাদের আওরঙ্গাবাদে মোস্তাক হোসেনের জন্ম। স্বাধীনতার পর দেশ সাড়ে সাত দশকের বেশি সময় অতিক্রম করেছে। জনসমাজ, অর্থনীতি, গ্রাম-শহরের রূপ---সবকিছুই বদলেছে। দেশ উন্নয়নশীলের তকমা থেকে ক্ষমতাশালী হওয়ার দিকে এগিয়ে গেছে এই সময়কালে। আর মোস্তাক হোসেন তাঁর বিপুল কর্মযজ্ঞ, মেধা, বিত্ত ও সমাজসেবার মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন একজন ‘সর্বজনীন ব্যক্তিত্ব’।
বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে বি-কম অনার্স পাশ করেন জনাব মোস্তাক হোসেন। বংশের প্রথম গ্র্যাজুয়েট ছিলেন তিনি। এরপর চলে আসেন কলকাতায়। সেখানেও তিনি সংগ্রাম করে গেছেন অনবরত। এই লড়াই নতুন করে শুরু হল যখন তাঁর পিতা গিয়াসুদ্দিন বিশ্বাস অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ব্যবসার নয়া দুনিয়া গড়ে তোলার জার্নি শুরু হয় আটের দশকেই। আজ সেই যাত্রা শিখর ছুঁয়েছে। শিল্পপতি মোস্তাক হোসেনের সেই জয়যাত্রা এখন স্বচক্ষে দেখছেন বাংলার মানুষ, ভারতের মানুষ। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ গঠনে মোস্তাক হোসেনের অবদান ইতিহাসের অনিবার্য অংশ হিসেবে থেকে যাবে, এটাই মানুষের বিশ্বাস।
তাঁর জীবন নিয়ে গবেষণা হবে, এ কথাও সত্য। মোস্তাক হোসেন ও তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য, শিল্পপতি মোস্তাক হোসেনের বহুমুখী শিল্পভাবনা, শিক্ষা প্রসারে মোস্তাক হোসেনের অবদান, মোস্তাক হোসেনের মানবতাবাদ---তাঁর জীবনের নানা দিক রয়েছে যেগুলি থেকে ভাবীকাল শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। মোস্তাক হোসেনের সমাজভাবনাও সুদূরপ্রসারী যা তাঁর লেখাপত্র, বক্তৃতা ও কাজেকর্মে প্রতিফলিত হয়। তাঁর চিন্তাভাবনার মধ্যে যে একটা দার্শনিকসুলভ বিষয় আছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনি লিখছেন, বিদ্যা আর অর্জিত জ্ঞানই মানুষের প্রকৃত বন্ধু। বুদ্ধি তার সহচর। স্বনির্মিত কর্ম তার পথপ্রদর্শক। অধ্যবসায় তার স্বরাজ্যের মন্ত্রী, সহিষ্ণুতা তার সেনাপতি। বিনয় তার সন্তান। ভদ্রতা ও রুচি তার সহোদর। তাঁর এই মার্জিত ভাবনা আমাদের নতুনভাবে পথ দেখায়। তিনি যে একজন মানবতাবাদী দার্শনিক তা প্রতিভাত হয়। তিনি জানাচ্ছেন, তোমার প্রতিবেশী যদি অনাহারে থাকে বা শিক্ষাহীনতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, সে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, জৈন, খ্রিস্টান-যে জাত বা ধর্মেরই হোক না কেন, তুমি যদি সম্পন্ন হও, অবশ্যই তাকে দেখবে। তবেই তুমি সৎ মুসলমান।
বাঙালির সমাজের শিক্ষা, বিত্ত ও সেবার ইতিহাস যখন লেখা হবে তখন মোস্তাক হোসেনের নামটি থাকবে সবার উপরে। তিনি এক ‘অন্ধকার’ গ্রাম থেকে উঠে এসেছিলেন। কিন্তু সেই অন্ধকার যাতে বাংলার গ্রামগুলিকে গ্রাস না করে ফেলে, সেই চেষ্টা তিনি সারা জীবন ধরে করে চলেছেন। মোস্তাক হোসেনের ভাষাতেই বলা যায়, ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোর নীচে বিরাজ করছে যে সব অন্ধকার, যে সব প্রত্যন্ত অঞ্চল এখন সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা করছে, আমরা সেসব অঞ্চলে যাব, পথশিশুকে কোলে তুলব, তাকেও সূর্যের আলো দেখাব।’ সেই আলো তিনি জ্বেলেছেন ‘চিত্ত’ ভয়শূন্য এবং শির উচ্চে রেখেই!
0 Comments