সুরাজ পাল

তাঁর বাবা বলতেন, ‘তোমাকে কিংবা তোমার পরিবারকে শুধু শিক্ষার আলো স্পর্শ করল আর চারপাশের বাকিরা অন্ধকারে পড়ে থাকল–তখন অন্ধকার আর আলোর মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে যাবে। তুমি যেহেতু সংখ্যায় দুর্বল, ফলে অন্ধকার জয়ী হয়ে তোমাকে, তোমার পরিবারকে গ্রাস করে ফেলবে। এজন্য আলোর চেহারা যাই হোক না কেন, তার ভাগ সবাইকে দিতে হবে। যে অক্ষরহীন, তার হাতেও অক্ষর তুলে দিয়ে দক্ষ করতে হবে।' বাবার এই উপদেশ আজ‌ও অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন তিনি। কথা বলছি মোস্তাক হোসেনকে নিয়ে। শিল্পপতি ও সমাজসেবী হিসেবে যিনি এক পরিচিত মুখ। আজ যে দরিদ্র মুসলমান সন্তানেরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট, বিজ্ঞান গবেষণায় সাফল্য পাচ্ছে, তার পিছনে এই মানুষটির অবদান অনেকখানি। সারা ভারতজুড়ে প্রায় ২ লক্ষের বেশি শ্রমিক তাঁর শিল্পের অধীনে কর্মরত। এমনকি পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসাকেন্দ্র জি. ডি. হাসপাতাল‌ও তাঁর উদ্যোগেই তৈরি। 



মোস্তাক হোসেনের জন্ম মুর্শিদাবাদ জেলার অওরঙ্গাবাদের চাঁদড়া গ্রামে। বাবা ব্যবসায়ী। স্বচ্ছল পরিবার। প্রাথমিক পড়াশোনা গ্রামেরই স্কুলে। পরে বহরমপুর রাজা কৃষ্ণনাথ কমার্স কলেজ থেকে হিসাবশাস্ত্রে বি.কম. করেন। চলে আসেন কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.কম-এ ভর্তি হলেও, বাবার অসুস্থতার কারণে পড়াশোনা অসম্পূর্ণ রেখে পারিবারিক ব্যবসাযর হাল ধরেন। সেইসময় তাঁদের ব্যবসার বাজার পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলাসহ অসম প্রদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল। অসমে আসু ও আবসু আন্দোলনের উত্তাল সময়ে অসম বাজার অনিশ্চিত হয়ে পড়লে তিনি দিল্লির দিকে পা রাখেন। এরপর হরিয়ানা, রাজস্থান, পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ, দক্ষিণ ভারতেও ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। দুনিয়াজোড়া ধূমপানবিরোধী প্রবণতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মূল ব্যবসার উৎপাদন ও বিপনন থেকে অনেকটা সরে এসে তিনি রেশম শিল্প, চা শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, ফুড পার্ক, স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিনিয়োগ বাড়ান। ইতালীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে মালদার নারায়ণপুরে ৪২  বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলেন অত্যাধুনিক রেশম কারখানা। ১২ নম্বর জাতীয় সড়ক সংলগ্ন মীরপুরে একশো একর জমির উপর শুরু করেন খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা। ১৯৯৩-এর টর্নেডো হোক বা ১৯৯৮ ও ২০০০-এর বন্যা কিংবা ২০০৯-এর আয়লা ঘূর্ণিঝড় অথবা কোভিড ১৯— সবসময় পশ্চিমবঙ্গবাসীর পাশে থেকেছে তাঁর পতাকা শিল্পগোষ্ঠী।

তবে সব ছাড়িয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি সমাদৃত। তিনি লিখেছেন, ‘....দুঃখের সঙ্গে বলছি, পূর্বগামীরা–আমার চাচারা তাঁদের বালক বয়সে সেজ দাদুর হুকুম মেনে কঠোর শাসন বরদাস্ত করে লেখাপড়া শিখতে থাকলে এলাকার চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন হত।' কথায় বলে শিক্ষাই একটি পরিবারকে, একটি সমাজকে, একটি রাষ্ট্রকে অগ্রগতির পথ দেখাতে পারে। সেই শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্য নিয়েই মুসলিম সমাজে নয়ের দশকে শুরু হয়েছিল শিক্ষা আন্দোলন। যার পুরোভাগে ছিলেন এম নুরুল ইসলাম। মূলত জাকাত-ফিতরার দানের টাকা তুলে তিনি আল-আমীন মিশনকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এত বড় সংস্থা গড়ে তোলার জন্য যে বিশাল অর্থের প্রয়োজন তা কিছুতেই যোগাড় করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই সময়ই পাশে এসে দাঁড়ান মোস্তাক হোসেন। পিছিয়ে পড়া সমাজের কল্যাণের জন্যই দুহাত ভরে অর্থ দান করেন। দক্ষিণ ভারতের শিক্ষা মডেলকে অনুসরণ করে গড়ে উঠেছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। আল-আমীন মিশনের প্রাথমিক পর্ব থেকে এখন‌ও পর্যন্ত যা উন্নয়ন হয়েছে প্রতিটি পদক্ষেপেই মোস্তাক হোসেনের অবদান রয়েছে। জিডি চ্যারিটেবিল সোসাইটির তত্ত্বাবধানে আজ ৬৫টির‌ও বেশি মিশন স্কুল পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ব্রতী হয়েছে। মিশনগুলোতে গৃহনির্মাণ প্রকল্প থেকে শুরু করে ছাত্র-ছাত্রীদের অনুদান প্রকল্প প্রতিক্ষেত্রেই কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে চলেছে তাঁর পতাকা শিল্পগোষ্ঠী। নিজ জন্মভূমি মুর্শিদাবাদে মা-বাবার নামে গড়ে তুলেছেন দিলখোশ অ্যাকাডেমি, দিলখোশ মেমোরিয়াল গার্লস হোস্টেল, দিলখোশ মেমোরিয়াল লাইব্রেরী, গিয়াসউদ্দিন সায়েন্স ল্যাবরেটরি, গিয়াসউদ্দিন-দিলখোশ বয়েজ হোস্টেল, আধুনিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ফি বছর মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে মিশন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের চমকপ্রদ ফলাফল জি.ডি. ট্রাস্টের সফলতাকেই তুলে ধরে।
নানা কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তিনি তিনটি গ্রন্থ লিখেছেন; নাম–নিশান ও নিশানা, গুহার ভেতর আলো, আলোর নীচে আঁধার। গ্রন্থগুলিতে তার চিন্তা-ভাবনার ছাপ অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি সবসময় ধর্ম শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষাকে গ্রহণ করার পক্ষে সওয়াল করেছেন। তার কথায়, ‘যে শিক্ষা দরকার তা কি পরিবার ও সমাজ মাতব্বররা জোগাতে পারছেন? শিক্ষার প্রতি যে আগ্রহ গড়ে ওঠা প্রয়োজন, তা কি গড়ে তুলতে তৈরি হয়েছে অনুকূল পরিবেশ ও যোগ্য প্রতিষ্ঠান?’ তিনি চাইলেই আর পাঁচজনের মতো বড় বড় স্কুল তৈরি করতে পারতেন। এ ব্যাপারে তাঁর সাফ বক্তব্য– ‘শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করব না’। তাঁর চ্যারিটেবল সংস্থা থেকে দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থাও রয়েছে। শুধু বেসরকারি আবাসিক স্কুল নয়, অওরঙ্গাবাদ কলেজ, ফরাক্কা কলেজ, উদয়নারায়ণপুর গার্লস কলেজের মতো সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশেও তিনি থেকেছেন। লিটিল ম্যাগাজিন প্রকাশ বা নতুন পত্রিকা সবেতেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। পুবের কলম, নতুন গতি, আরম্ভ, উদার আকাশ পত্রিকাকে নিয়মিত বিজ্ঞাপন দিয়ে সহযোগিতা করে চলেছেন তিনি। পত্রিকাগুলো মুসলমান জনগণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে, সচেতনতা জাগাতে এবং জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। মুসলিম সাহিত্য ও সংস্কৃতি জনপরিসরে ছড়িয়ে দিতেও পত্রিকাগুলোর অবদান অনেকখানি। বাংলার বাইরের দানবীর শিল্পপতিদের কথা আমরা কম-বেশি জানলেও, নিজের রাজ্যের মহতী মানুষের খোঁজ রাখি না। মোস্তাক হোসেনের বহুধা কর্মধারার সঙ্গে সাধারণ পাঠককে পরিচয় করানোর ক্ষেত্রে উদার আকাশের প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আর‌ও শিল্পপতিরা শিক্ষা বিস্তারে এগিয়ে এলে আখেরে লাভবান হবে দেশ।

লেখক: সুরাজ পাল। গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।