*✍কমলেশের কলম✍
*সাম্য শব্দটির সঙ্গে আমাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় হয়ে ওঠে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাম্য’ কবিতার মাধ্যমে। সাম্য মানেই, সমান বা সমতাবিধান । মানুষ সমাজে বসবাস করে।তাই সমাজবদ্ধভাবে মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বেঁচে থাকার জন্য সমান অধিকার হয়ে বাঁচতে চায়। বতর্মানে সমাজে তিন শ্রেণির লোক বসবাস করে উচ্চ-মধ্য-নিম্ন ।এই তিন শ্রেণির লোক একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে থাকাটা আজকের যুগে অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে। নিম্ন শ্রেণির লোক সবসময় মধ্য-উচ্চবিত্ত লোকদের সঙ্গে মিশে থাকতে চায়, কিন্তু মেশা তো দূরের কথা তাদের পাত্তাও দেয় না উচ্চবিত্ত লোকজন। প্রাচীনকালে এই বাংলায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, ও শূদ্র এ চার প্রকার বর্ণের লোক বসবাস করত। এর মধ্যে ‘ব্রাহ্মণদের’ স্থান ছিল সমাজের সর্ব্বাচ্চ স্থানে যা বতর্মানে ‘উচ্চ শ্রেণির’ সঙ্গে প্রায় মিল রয়েছে ‘ ।* *ক্ষত্রিয়দের’ সঙ্গে বতর্মানে মিল খুঁজে পাওয়া যায় ‘মধ্যম শ্রেণির’ লোকদের। অন্যদিকে প্রাচীনকালে ‘শূদ্রদের’ স্থান ছিল করুন অবস্থা বতর্মানে মিল খুঁজে পাওয়া যায় ‘নিম্নশ্রেণির’ লোকদের। কিন্তু প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণ বাদে অন্যসব বণের্র লোকজন একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা করত। বতর্মানে সমাজে উচ্চ-মধ্যম এরা সবসময় মিলেমিশে থাকতে চায়। আর নিম্নে বণের্র লোকদের সঙ্গে কেউ মিশতে চায় না। কেউ তাদের কোনো কাজের পাত্তাও দেয় না ।কথা বলা তো দূরের কথা, কোনো ন্যায্য কথার মূল্যও দেয় না। যে কোনো কথা ধুমকে-চমকে বন্ধ রাখে। অসহায় গরিব পরিবারের সন্তানরা উচ্চশিক্ষিত হলেও তাদের সম্মান তো দূরের কথা কিছু স্বার্থপর সমাজকর্মীরা টাকার দাপটে সম্মানহানীও করে। এমনকি- মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখে। এটা কি হতে পারে সাম্যের সমাজ?*
*সামাজিক সাম্যতা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতে না পারলে একদিন অসাম্যের সমাজ গড়ে উঠবে। ফলে সমাজে একদিন বর্বরতা, হানাহানি, মারামারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা অন্ধকার রূপে এসে দাঁড়াবে। এ সবের পিছনে একদিন কারণ হয়ে দাঁড়াবে সমাজের যুবসমাজ। বতর্মানে আমাদের সমাজজীবনে চরম অবক্ষয়ের চিত্র জীবন্ত হয়ে আছে । যাহা যুবসমাজকে প্রভাবিত করছে। দোলা দিচ্ছে তাদের মন-মানসিকতাকে। আমাদের যুবসমাজের সামনে আজ কোনো আদর্শ নেই। নেই অনুপ্রাণিত করার মন কোনো মহৎপ্রাণ আলোকিত মানুষ। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। সাম্যর সমাজকে নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মতো কোনো পরিকল্পনা নেই ।ফলে তারা প্রতিনিয়ত ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সমাজে সমাজে বিরোধীর যে সম্মান, যে প্রতিপত্তি, সেখানে একজন জ্ঞানী, সৎ মানুষের মূল্য তুচ্ছ। সত্য সেখানে লাঞ্চিত, অসহায়। বিবেক সেখানে বিবর্জিত। জ্ঞানী-গুণীরাও তাদের খাতির করে। জঘন্য, নিষ্ঠুর কাজকর্ম করে ও তারা সমাজের চোখে নিরাপদ। সমাজের প্রভাবশালীরা অনায়াসে মানুষ খুন করে, ডাকাতি করে, জনজীবনে ত্রাসের সৃষ্টি করে। কোনো অন্যায় যেন সমাজে আজ অন্যায় বলে বিবেচিত হয়না। নীতিভ্রষ্ট মানুষ আজকের দিনে নিজেকে অপরাধী বলেও বিবেচনা করে না। দুর্নীতির মাধ্যমে বিত্তশালী হয়েও তারা নিজেরা কখনও সঙ্কোচবোধ করে না। বরং অর্থের গৌরবে বক্ষ স্ফীত করে চলে। অবৈধ উপায়ে উপার্জনের প্রতিযোগিতা চলছে সমাজে। সমাজে প্রভাবশালীরা অর্থের দাপটে অযোগ্য লোকদের চাকরি দিয়ে দিচ্ছে। ওইদিকে পড়ে থাকে উচ্চ-শিক্ষিত কৃষকের ছেলেমেয়ে ।চাকরি তো দূরের কথা একটু আশাও দেয় না ।নিঃশ্বাসের আর শেষ থাকে না দুঃখিনীদের। যখন পড়ালেখা শেষ করে অথর্সংকটে অভাবে চাকরি মেলে না তখন কৃষকের ছেলেমেয়েদের অবস্থা কিরূপ হতে পারে।*
*কে দেবে তাকে আলোর পথের সন্ধান?*
*কে নিয়ে যাবে সেই আলোর পথে?*
*আমাদের দেশ ও সমাজে সর্বত্র একটা অস্থিরতা। সব মানুষ যেন অধীর, সবাই যেন কোনো না কোনো অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। শিক্ষার প্রতি অনুরাগ, ন্যায়ের প্রতি কারও আগ্রহ নেই। বেড়েছে ভোগবাদী প্রবণতা, কর্তব্যের প্রতি অবহেলা, সহানুভূতির পরিবর্তে মানুষের প্রতি মানুষের অবহেলা, স্বার্থ সাধনের জন্য ব্যাপক তৎপরতা, জনকল্যাণের প্রতি অনীহা। এসব মূল্যবোধহীন বিষয় মানুষের জীবনকে অস্থির করে তুলছে। আমাদের সমাজে বেড়েছে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বেড়েছে দুর্নীতি মূল্যবোধের অবক্ষয়, অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, দারিদ্র্যতা। কিন্তু বাড়ছে না মানুষের জন্য মানুষের সৌহার্দ্য, সহানুভূতি ,সংবেদনশীলতা।*
*কিন্তু কেন?*
*এর উত্তর খুঁজে বের করতে গেলে নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাব পরিলক্ষিত হয়। নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে জাতি আজ চরম সংকটে পতিত হয়েছে। সমাজের নৈতিক অধঃপতনের কারণে সামাজিক সমস্যা বাড়ছে । এর ফলে সমাজজীবন অস্থির ও অশান্ত হয়ে উঠেছে। মানুষের মধ্যে ভোগবাদী প্রবণতা,বিলাসিতা প্রভৃতি বেড়ে যাওয়ায় সমাজের লোভ, মিথ্যাচার, আদর্শহীনতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, ঘুষ, জালিয়াতি, রাহাজানি, ইত্যাদি সমাজবিরোধী কর্মকান্ড বেড়ে গেছে । সর্বোপরি নৈতিক শিক্ষার জন্য সমাজে যে আদর্শ থাকার কথা তা ক্রমেই নানা কারনে হ্রাস পেয়েছে । ফলে অনৈতিক মূল্যবোধ শূন্যতা দেখা দিয়েছে। এই সব দূর করার জন্য সামাজিক সাম্যতা এমনভাবে হতে হবে যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও পেশাগত কারণে যখন মানুষে মানুষে কোনো পাথর্ক্য করা হবে না এবং সমাজে বসবাসরত সব মানুষ যোগ্যতা অনুযায়ী একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। ধনী-গরিব হবে ভাই ভাই; কোনো ধরনের বৈষম্য থাকবে না। বিশেষ করে উচ্চবিত্ত লোকদের খেয়াল করতে হবে সমস্ত মৌলিক অধিকার থেকে যাতে কেউ বঞ্চিত না হয়। দরিদ্রদের সেই দিকে নজর দিতে হবে। এজন্য হাত বাড়াতে হবে অর্থর। অর্থের বিত্তশালীদের নজর দিতে হবে ।সমাজের দাসকৃত অর্থর সবাই সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে কিনা এবং সমাজের বসবাসরত প্রতিবন্ধীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সমানভাবে দিচ্ছে কিনা; সমাজের অথার্ভাবে তরুণ মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা অর্থর সংকটে পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কিনা তো দেখা কর্তব্য ।সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের নীতিগ্রহণ করে। কিন্তু সেই নীতিমালা ধনি শ্রেণির লোকেরা গায়ের জোরে নিজেরাই পরিবর্তন করে । সেদিকে সক্রিয় হতে হবে সব নাগরিকের। অসাম্যর সমাজকে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে একমাত্র আদর্শ যুবকরা। তারাই পারে সমাজে যত দ্ব›দ্ব,কলহ, অথনৈতিক সংকট মেটাতে। এ ছাড়া সমাজে রন্ধ্রে-রন্ধ্রে শিক্ষার আলো পৌঁছানো ও সামাজিক মূল্যবোধ জাগাতে। মূল্যবোধ এমন একটি ভিত্তি যেখানে দীর্ঘদিনের আচার-আচরণ, বিশ্বাস দৃষ্টিভঙ্গি। দীর্ঘ অনুশীলনের বিশ্বাস দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধকে গ্রহণ ও লালন করা হয়। যেগুলো ব্যক্তি ও সমাজের জন্য কল্যাণকর, সঠিক ও কাঙ্খিত। সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, স্নেহ-প্রীতি, সহমর্মিতা, সহনশীলতা ইত্যাদি মনোভাব গড়ে উঠবে। সমাজ যাতে সাম্য অসাম্যর দিকে না যায় এ জন্য সমাজে বসবাসরত সব নাগরিককের নৈতিক শিক্ষাবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ উভয় মাধ্যমে সমাজে মানুষ সাম্যভাব, শান্ত স্বভাব, মার্জিত আচরণ ও প্রজ্ঞার অধিকারী হতে পারবে। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষকে সুখী হতে হবে এবং তাদের মানবতাবোধ জাগ্রত করতে সহায়তা করবে। এর ফলে সমাজের ঘুষ, দুর্নীতি, বঞ্চনা, শোষণ, স্বার্থপরতা, এইসব থেকে সমাজ মুক্ত হবে। মুক্ত হলে সমাজে মানুষে মানুষে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ কোনো অহংকার, একদিন আদর্শ সমাজ গড়ে উঠবে, আদর্শ জাতি গড়ে উঠবে, দেশ হবে সুখীসমৃদ্ধ অসাম্যহীন আদর্শ সমাজ।
0 Comments