উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষে কত ভাবনা জুটেছিল নাফিকের।

রেজাল্ট বের হলে কলেজ জীবনে প্রবেশ করবে সে। নতুন বন্ধু-বান্ধব, নতুন পরিবেশ -- এসব ভাবতে থাকে সে। সে চায় প্রকৃত মানুষ হতে। সমাজের জন্য কিছু করতে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সমাজের কল্যাণে ছোট্ট ছোট্ট কাজ করে সে। ছোটোবেলা থেকেই রাস্তায় পড়ে-থাকা ইটের টুকরো, কলার খোসা বা ভাঙা কাচের টুকরো, ডাবের খোল দেখলে সে সরিয়ে রাখে নিরাপদ দূরত্বে। 
     
     মনে পড়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে নাফিক আহমেদ। সে ভালো রেজাল্ট করা ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কলারশিপের ফর্ম জোগাড় করে। সেই ফর্ম পূরণ করে জমাও দিয়ে আসে বিভিন্ন দফতরে। গরিব ছাত্র স্বপন ও নিজামের জন্য বইও কিনে দেয়। 


     একবার স্কুল জীবনে বাড়ির বিনা অনুমতিতেই পাড়ার একটি ছেলে কুতুবউদ্দিন গাজীর সঙ্গে চৈতালি প্রেক্ষাগৃহে একটি সিনেমা দেখতে যায়। শাহরুখ খানের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়। "ডর" সিনেমার গান গুলো মনে দাগ কাটে। জাদু তেরি নজর...। 

ফেরার সময় আমগাছের ফাঁক দিয়ে জানালায় একটি কিশোরী মেয়েকে দেখতে পায় সে। অপরূপা সুন্দরী মেয়েটি। কিন্তু সবচেয়ে মুগ্ধ করে সেই মেয়েটির চোখ দুটি। মুখের দুধে-আলতা রঙের মধ্যে নীল দুটি তারা-মণি তার চোখ দুটিকে আকাশের তারার মতো উজ্জ্বল করে রেখেছে। 
     
     সেদিন সিনেমা দেখে ফিরে রাতে আর ঘুম আসতে চায় না নাফিকের। ঘরে শুয়েও যেন আকাশ দেখে সে। আর সেই আকাশ জুড়ে জ্বলজ্বল করছে সেই দুটি মূল্যবান চোখের তারা। 
     
     সেবার নাফিক তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে সব খেলায় শেষের দিক থেকে প্রথম হয়। ঘটকপুকুর হাই স্কুল ও গার্লস স্কুল পাশাপাশি হওয়ায় খেলার একটাই মাঠ। নাফিক দৌড়ে সবার পিছনে পড়ে যায়, এতে অনেকেই হাসাহাসি করে। নাফিক দৌড়ে সবার পিছনে পড়ে যাওয়ার জন্য লজ্জাও পায়।



     
     বাড়ি ফিরে সে মাকে সব বললো। তার মায়ের পরামর্শ মতো নিয়মিত সারা বছর সে দৌড় অনুশীলন করলো। পরের বছর নাফিক দৌড়ে প্রথম হলো। বেশ কয়েকটি প্রাইজও পেল। মনে মনে ঠিক করল সে চেষ্টা করলে পড়াশোনাতেও ভালো করতে পারবে। একটা জেদ চেপেছিল ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। 
     
     ক্লাস নাইনে উঠে শপথ নিল নিজের মনে সে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে। সেইমতো অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে সারাবছর পড়াশোনা করলো। তাদের স্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষার সিট পড়ে বোদরা হাইস্কুলে। মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথম দিন পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় সেই নীল নয়নাকে আবার দেখতে পেল। 

     নাফিক পরীক্ষা দিতে এসেছে, সর্বক্ষণের সঙ্গী একটা ভাঙা-চোরা সাইকেল নিয়ে। গায়ে ঘটকপুকুর চৌমাথার ফুটপাত থেকে কেনা সবুজ রঙের গোলগোলা গেঞ্জি। স্কুল যাওয়ার জন্য একটিমাত্র প্যান্ট। সেই প্যান্ট আর গেঞ্জি পরেই পরীক্ষা দিতে এসেছে বোদরা হাইস্কুলে। আম বাগানের ফাঁক দিয়ে দেখা সেই চোখ। স্বপ্নের পরীর মতো রাজকন্যা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। গেটের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা নাফিক তা দেখে চমকে উঠে। নাফিকের চোখ পড়লো যখন তার চোখে তখন সে দেখল তার হাতে একটি পিজবোর্ড একটি পেন্সিল বাক্স। বার্বরি কাট চুল আর ভুবন জয়ের হাসিতে সে জে কি জাদু, তা শুধু নাফিকই জানে। 
     
     নাফিকের ভাঙা টালির ছাউনি দিয়ে বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর। ভিজে যায় বিছানার চাদর। অন্য দিকে ভালবাসার জন্য কিছু করে দেখানোর জেদ। তাই সে বই কলম খাতা নিয়ে পড়তে বসে। আর ভাবে একদিন সে তার ভালবাসার মানুষের  সামনে গিয়ে সব মনের কথা খুলে বলবে। 
     
     নাফিক স্কুল জীবনে দু'টো পরীক্ষাতেই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে। কলেজ জীবন শেষ করে ভালবাসাকে পাওয়ার জন্য সে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস সেক্রেটারি পদে কাজ জোগাড় করে নেয়। সাবলম্বী হয়ে তারপর প্রিয় রাজকন্যার মুখোমুখি হবে। সে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার দৌড়ে ছুটে চলেছে। শিক্ষামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে নাফিক রাত দিন সোসাইটির কাজে আত্মনিয়োগ করে। 
     
     জীবনে চলার পথে জুটেছে কত তাচ্ছিল্য, কত যন্ত্রণা তা কেউ জানে না। অবজ্ঞার পাহাড় নিয়ে আজও পবিত্র ভালবাসার অপেক্ষায় প্রহর গুনে-গুনে রাত কাটে নাফিকের। কখনও মনে পড়ে স্কুল-কলেজ জীবনের ফেলে আসা সেই সব দিন। 
     
     চাকরি করতে করতে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দূর-শিক্ষা বিভাগ থেকে সাহিত্য ও ইতিহাস বিভাগে এমএ পাশ করে সে। আগামি দিনে আরও ভালো চাকরি পাবার আশায় পিএইচডি ডিগ্রির জন্য ভর্তি হয় স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে।
     
     সোসাইটির কাজটা তা খুবই পছন্দের। ছোটোবেলা থেকেই মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছা তার। এখানে সেই সুযোগ পেয়েছে সে। তাই আরও একাগ্রতা নিয়ে কাজে মন দেয়। সোসাইটির কাজ জোর কদমে চলে এবং সোসাইটি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্রুত বিস্তারলাভ করে। কিন্তু ঈর্ষাকাতর কিছু মানুষের তা ভালো না লাগায় শুরু হল ষড়যন্ত্র। কর্তৃপক্ষ ভুল বুঝে অপমান করে। অপমান সহ্য না করতে পেরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নাফিক  নতুন চাকরি নিয়ে চলে আসে শহরে।    
     
     আবার শুরু হয় কঠিন লড়াই। অবিরাম কাজের চাপে ভুলে থাকা হৃদয়ের রাজকন্যার মুখটা আবার ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ঘুমে-জাগরণে দেখতে পায় আমবাগানের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাওয়া সেই দুটি নীল চোখ। আজও যে চোখে সরাসরি চোখ রাখা হয়নি। সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারিনি হৃদয়ে লুকিয়ে রাখা ভালবাসার কথা। 
     
     কিন্তু ওই কথায় বলে না, নদীর এক কূল ভাঙলে আর এক কূল গড়ে। তেমনি আবার একটা চাকরি পেয়ে যায় জীবনধারণের মতো।

 কর্মক্ষেত্রের কাছাকাছি ছোটো একটা ফ্ল্যাটে শুরু হল ছিমছাম জীবনযাপন। পূজার ছুটিতে বাড়ি ফিরে শোনে আমবাগানের ফাঁক দিয়ে সেই রাজকন্যাকে কোনও এক রাজার কুমার এসে পক্ষীরাজে চাপিয়ে নিয়ে উড়ে চলে গেছে। 
     
     ভাঙা-বুক নিয়ে কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসে নাফিক। 

     বেশ তো ছিল। কী দেখলো আজ কল্যাণপুর স্টেশনে? সেই দুটি চোখ? হ্যাঁ, সেই চোখই তো! যে চোখ জাগিয়ে রেখেছে আজ চল্লিশটা বসন্ত। তাকি ভুলে যাওয়ার মতো? 
     
     বুকের ভেতরটা যেন তোলপাড় করছে। হাতুড়ি পিটছে ঢিপ-ঢিপ করে হৃদপিন্ডটা। মনে সাহস এনে এগিয়ে যায় নাফিক। 
     
     সেই চোখ একটা জলের বোতল স্টেশনের দোকান থেকে কিনে নিয়ে দ্রুত পায়ে ট্রেনের দরজার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। 
     
     নাফিকও ততোধিক দ্রুত পায়ে ট্রেনের দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, "তোমার,... না... মানে আপনার নাম কি সা...." 
     মহিলা ট্রেনের দরজার হাতল ধরে একপা পাদানিতে রেখে নাফিকের দিকে ফিরতেই ভিতর থেকে নাফিকের সমবয়সি এক ভদ্রলোক চিৎকার করে ডাক দিলেন, "এই সাকিনা, উঠে পড়, গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে তো!" 
     
     নাফিকের কথার উত্তর দেবার আগেই রেলের চাকা গড়িয়ে যায়। সে দেখতে পায় ভদ্রমহিলা উপরে দাঁড়িয়ে দরজার মাঝখানের দন্ডটি ধরে কিছু একটা ঠোঁট নেড়ে বললেন বটে কিন্তু রেলের তীব্র হুইসেলের শব্দে তা আর নাফিকের শোনা হল না।