“কাজী সাহেব শুনছেন”
কেমন আছেন কাজী সাহেব? মন ভালো নেই নিশ্চয়ই ? জানি তো কাজী সাহেব। ভালো থাকবেনই বা কেমন করে। কত আশা নিয়ে কত কষ্ট উপেক্ষা করে গোরাদের গোলামী না করে “কারার ঐ লৌহকপাট” এর ওপাড়ে জীবনের অমুল্য সময়গুলো নষ্ট না করে কারাগারেই রচনা করলেন কত কবিতা গান গল্প। আপনার ত্যাগ ও বিদ্রোহী হুঙ্কার গোরাদের বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে পরাধীনতার দুঃসহ জীবন থেকে আমাদেরকে স্বাধীন হবার পথ মশ্রিন করলো আর আজ আপনার এ কি পরিনতি? আপনার জন্মদিন আমরা জানতে পারি সোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে। যখন জানি তখন আমাদের সম্বিৎ ফেরে। অবশ্য কিছু মানুষ এর ব্যতিক্রম আছেন তবে তা খুবই নগন্য। জানিনা আপনাকে নিয়ে এত অনিহা কেন? বছরে শুধু একদিন আমরা সোসাল সাইট ভরিয়ে দেই বিদ্রোহী কবির স্মৃতি চারনায়, আর বাকি ৩৬৪ দিন? হায়রে স্বাধীন জাতি শুধু নিজের নিজের করেই গেলাম। আপনার সেই “মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম” আর নেই। আছে ধর্মের নামে বজ্জাতি,জাতের নামে বজ্জাতি , রাজনীতির নামে বজ্জাতি। একবৃন্ত এখন বহুবৃন্তে রুপান্তরিত হয়েছে। দুটি কুসুম এখন আর কোলাকুলি করে না। আমি তো জানি আপনি স্বাত্বিক মুসলমান ছিলেন তা সত্বেও হিন্দুদের কে আপন করে নিয়েছিলেন। আপনার হাত দিয়েই তো কালজয়ী শ্যামাসংগীতের লেখা প্রকাশ পেয়েছিল যা আজও হিন্দুদের ঘরে ঘরে ও নানান মন্দিরে নিঃসংকোচে বেজে চলে ছোঁয়াছুঁয়ির উর্ধ্বে গিয়ে। আপনি বিবাহ করে ছিলেন এক হিন্দু নারীকে এবং তার সমস্থ পুজায়ার্চা নিয়মনিষ্ঠা যাতে সঠিক ভাবে পালন করেন তার জন্য আপনি মত প্রদান করেছিলেন। আমরা জানি আপনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ কাজী নজরুল ইসলাম। শুনেছি আপনি নাকি বিদ্রোহী কবি ,আর আপনার সেই বিদ্রোহের আগুনে গোরারা ভয়ে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। তাহলে কোথায় গেল আপনার সেই বিদ্রোহ ? কোথায় গেল সেই হার না মানা তেজ ? কি ভাবছেন কাজী সাহেব ? আপনি কি আধুনিক স্বাধীনতার রুপান্তর দেখে শান্ত হয়ে গেছেন? হবারই কথা। কিন্তু আপনি যে বলেছিলেন
“মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি আমি সেই দিন হব শান্ত” !
সেই দিন কি এখনো আসেনি কাজী সাহেব? এখন যে আপনাকে আমাদের খুব প্রয়োজন। কবে আসবেন আপনি? কবে ধরবেন হাল? কবে বেজে উঠবে আগুন ঝরানো কবিতা আর গান।
একটা অভিযোগ না করে পারছি না। আপনার প্রিয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপনার সাথেই থাকতেন। কিন্তু আজকাল বিদ্রোহি কবিকে কবিগুরুর সাথে খুব একটা দেখতে পাই না। রবীন্দ্রজয়ন্তি ধুমধাম করে হয়। চারিদিকে বেজে চলে রবীন্দ্র সংগীত শুধুই রবীন্দ্র সংগীত। আপনি তো চিরকালই আমাদের জন্য প্রানপাত করে গেলেন। যে কবি সমগ্র ভারতীয়কে তার বিদ্রোহী লেখায় গায়ের রক্ত গরম করে তুলতেন আজ সেই কবি কি ব্রাত্য হয়ে গেলেন? আপনার প্রয়োজন কি ফুরিয়েছে এই সভ্য সমাজের কাছে? আজকের নব সমাজের নব্য নবীনরা শুধুই কবিগুরু কবিগুরু করেই গেলো। আমি তো শুনেছি আপনাকে নাকি কবিগুরু খুব ভালবাসতেন। উনি নাকি আপনার লেখার খুব গুনগ্রাহী ছিলেন। তবে এখনকার শিশু যুবারা কেন বিদ্রোহী কবির অসাধারন সব কবিতা ও গানের অন্তরনিহিত স্বাদ হতে বঞ্চিত হচ্ছে। কোথায় গেল সেই স্বর্নযুগের নজরুলগীতি? জানিনা আমি জানিনা কেন এই অনিহা। আপনার প্রিয় বাংলা হয়েছে দ্বিখন্ডিত আর আপনার ভারত হয়েছে তৃখন্ডিত। জানিনা আরও কত খন্ড বিখন্ড দেখতে হবে আমাদের।এখন আর ভারতীয়দের সাথে গোরাদের লড়াই নেই। গোরারা আমাদের খুব ভালো বন্ধু। শুধু ইংরেজ গোরারাই নয়। আমেরিকা রাশিয়া ফ্রান্স জার্মানির সবাই বন্ধু। ভাবছেন তাহলে তো আমরা খুব শান্তিতেই আছি। কেনই বা আপনাকে বিরক্ত করছি। না কবি না আমরা মোটেই শান্তিতে নেই। একটা দেশ ভেঙে তিনটে দেশ হলো আর আজ এই ভারত বাংলাদেশ আর পাকিস্তান তো নিজেরাই খেয়োখেয়ি করে মরছে। আপনি তো ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্য্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় অতিবাহিত করেছেন। স্বাধীনতার প্রকৃত রুপ দেখেন নি। হয়তো বা বুঝেও চুপ করে গেছেন অভিমানে। আমি তখন খুব ছোটো। ক্লাস ফাইভে পড়ি। ১৯৭৬সাল ২৯শে আগষ্ট। স্কুলে থাকাকালিন জানতে পারলাম আপনি আমাদের ছেড়ে স্বর্গ লোকে পাড়ি দিয়েছেন। হেড মাস্টার মশাই সেদিন স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছিলেন । আমি হাফ ছুটি পেয়ে আনন্দে ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসেছিলাম। তখন বুঝিনি আপনি আমার কোন পরমাত্মীয়। কি হারিয়ে ছিলাম তা বড় হয়ে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছিলাম যা আজও বহে নিয়ে চলেছি অন্তরের গভীরে। সুযোগ পেলেই প্রিয় গায়িকা ফিরোজা বেগমের কন্ঠে “আমি যার নুপুরের ছন্দে” “নয়ন ভরা জল গো” “তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি” আর মান্না দের কন্ঠে “শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে” “কুহু কুহু কোয়েলিয়া” আপনার গানগুলি শুনে পরম তৃপ্তি লাভ করি। আর আপনার সুযোগ্য পুত্র কাজী সব্যসাচীর কন্ঠে আপনার লেখা কবিতাগুলি “বল বীর বল চির উন্নত মম শির” “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছে জুয়া” যখন শুনি তখন রক্ত আমার টগবগ করে ফোঁটে।
আপনার কাছে তাই আমার বিনম্র অনুরোধ যে আপনিই পারেন এই সংকট হইতে আমাদের উদ্ধার করতে। আপনি আবার পৃথীবির বুকে এসে এই সমাজে মুখোশধারী দেশী গোরাদেরকে আপনার সেই বিদ্রোহের আগুনে জ্বালিয়ে দিয়ে এ সমাজকে নতুন দিশা দেখান। আবার শুরু হোক রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যা। সবার কন্ঠে আবার উচ্চারিত হোক “একই বৃন্তে দুটি কুসুম রবীন্দ্র আর নজরুল”। আপনাকে আমার শতকোটি প্রনাম🙏🙏🙏
0 Comments