"জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে এত বেশি বিরল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটিয়াছিল যে, তাহার বিস্তারিত বর্ণনা দিতে গেলে কয়েক খণ্ড পুস্তক রচনার প্রয়ােজন। সুদীর্ঘ প্রায় এক চতুর্থাংশ শতাব্দীকাল তাঁহার সংস্পর্শে থাকার ফলে আমার মনের কোণে তাহার যে ছবিটি অঙ্কিত হইয়াছে, প্রকৃতপক্ষে তাহা কোনাে সাধারণ মানুষের নহে, একজন প্রায় অতিমানবের। তাঁহার মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের মহৎ গুণের যে সমাবেশ ঘটিয়াছিল তাহাই তাহাকে একজন বিরাট ব্যক্তিত্বশালী মানুষে পরিণত করিয়াছিল।
...জনাব সোহরাওয়ার্দী দেশভাগের পর ভারতে ফেলিয়া আসা অসহায় মুসলমানদের জন্য যাহা করিয়াছেন, তাহা একদিকে যেমন তাঁহার উচ্চমানের কর্তব্যবােধের পরিচায়ক, অন্যদিকে তেমনি অপরিসীম ত্যাগের প্রমাণ। অসহায় মুসলমানদের রক্ষা করার মহান উদ্দেশ্য সাধন করিতে যাইয়া তাঁহাকে কায়েদে আজমের একটি নয়, দুইটি নয়, পাঁচ-পাঁচটি উচ্চপদ গ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিতে হয়। কায়েদে আজম তাঁহাকে (১) ভারতে পাকিস্তানী হাইকমিশনার, (২) পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় মন্ত্রিত্ব, (৩) পাঞ্জাবের গর্ভনর পদ, (৪) জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধির পদ এবং সর্বশেষ (৫) বিদেশে কায়েদে আজমের ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূতের পদ গ্রহণের প্রস্তাব দিয়াছিলেন। কিন্তু ভারতের অসহায় মুসলমানদের রক্ষার চাইতে তিনি কোনাে উচ্চপদকেই বড় মনে করেন নাই। তাই কোনাে পদ গ্রহণে অসম্মতি জানাইয়া তিনি ভারতে থাকিয়া সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়িয়া তােলার কাজে আত্মনিয়ােগ করিলেন এবং একে একে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার লীলাভূমি কলিকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য স্থান, পূর্ব পাঞ্জাব, আলওয়ার, ভরতপুর, দিল্লি ও যুক্ত প্রদেশ সফর করিলেন। এই সকল স্থানের কোনাে কোনাটায় তিনি মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে গিয়াছিলেন, আবার কোনাে কোন স্থানে একাকীই গিয়াছিলেন। তবে সব জায়গাতেই তাঁহার জীবন বিপন্ন ছিলাে। শুধু ভারতে নহে, তিনি পূর্ববাংলাও সফর করিলেন এবং বিভিন্ন স্থানে সভা-সমিতি করিয়া মানুষের নিকট পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের স্বার্থেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করিলেন। এই শান্তি-মিশনে জনগণের অভ্যর্থনা, অভিনন্দন ও সাড়ার মাধ্যমে তাদের অচিন্তনীয় জনপ্রিয়তার যে চিত্র ফুটিয়া উঠিলাে, সদ্দৃষ্টি ক্ষমতাসীনদের বুক কাঁপিয়া উঠিলাে।
- নেতাকে যেমন দেখিয়াছি, শেখ মুজিবুর রহমান, গনতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (স্মারক গ্রন্থ), পৃঃ ৩০৩
"এখানে ঘুমায় সিংহ-হৃদয় সংগ্রামী মহাপ্রাণ,
শৌর্য-সাহসে অতুলন, শির উন্নত,মহীয়ান,
প্রাণাবেগে যাঁর জেগেছিল কোটি পঙ্গু মুসলমান
(আজাদী জঙ্গে পেল যার সাথে আজাদ পাকিস্তান),
গণতন্ত্রের উদ্গাতা- চির ভাস্বর, অম্লান;
এখানে ঘুমায় পাকিস্তানের সেই বীর সন্তান"।
-ফররুখ আহমদ
.
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলার মানুষের কাছে ত্রানকর্তা হিসেবে অভিভূত হন বেশ কয়েকবার। প্রধানমন্ত্রী হবার পরে বাংলার মানুষকে বাচিঁয়েছিলেন উগ্রবাদী হিন্দুদের দাঙ্গার আগুন থেকে। বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের জমিদারি থেকে। তার অসাধারণ নেতৃত্বগুনে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে একমাত্র বাংলা প্রদেশেই মুসলিম লীগ জয় লাভ করে। যদি ফলাফল ভিন্ন হতো তাহলে পাকিস্তান আন্দোলন আরো কঠিন হয়ে যেতো। ১৯৪৬ সালের ঐতিহাসিক দিল্লী সম্মেলনে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীই পাকিস্তান প্রস্তাব ঘোষণা করেন।
.
১৯৬৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরে আবুল মনসুর আহমদ বলেছিলেন জনাব সোহরাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যুে আমাদের যে কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল তা বুঝতে একটু সময় লাগবে। আমাদের ৭ বছর সময় লেগেছিলো। সব রাজনৈতিক বিশ্লেষকই এখানে একমত যদি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জীবিত থাকতেন তাহলে,
এক- আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে কমপক্ষে ৩০/৩৫ টা আসনে জয় লাভ করতো।
দুই- উনার প্রবল ব্যক্তিত্বের সামনে ভুট্টো বা ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গরিমিসি করার সাহস পেতেন না।
তিন- বাঙালিকে এই হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতনের মুখে পড়তে হতো না।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মৃত্যুর পরে পুরো উপমহাদেশ শোকে ভেঙ্গে পরে। ঢাকায় উনার লাশ আসার পরে করুন অবস্থার সৃষ্টি হয়। জনগন কিছুতেই মহান নেতার প্রয়ান মেনে নিতে পারছিলো না। জনস্রোত এসে মিশে যায় ঢাকায়। জানাজার নামাজ পাঁচবার পড়তে হলো। জনতা ক্রমেই আসতে থাকে এবং তারা জানাজার নামাজ পড়ার জন্য দাবি করতে থাকে। আনুমানিক পাঁচ লাখ লোক জানাজায় অংশ নেয়।
#
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দ্বি-জাতি তত্ত্বের একজন জনক। যারা দ্বি-জাতি তত্ত্বকে সাম্প্রদায়িক তত্ত্ব বলে তাদের জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চপোটাঘাত। বাংলার প্রধানমন্ত্রী হবার পরের একটা ঘটনা উল্লেখ করছি,
"সোহরাওয়ার্দী সাহেব উদীয়মান দেশী ব্যবসায়ী রায় বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহাকে আগে থেকে চিনতেন এবং তার দরদী মনের কথা জানতেন। তিনি তাকে ডেকে বললেন, আমি তোমাকে একটি বড় কাজ দেব। কাজটি যদি তুমি ঠিকমত করতে পার, তবে সমস্ত দেশবাসী উপকৃত হবে। বাংলাদেশের তাঁতিদের হাতে সুতা পৌছাবার জন্য আমি তোমাকে সারা বাংলার একক ডিস্ট্রিবিউটর নিযুক্ত করবো। তুমি বেঙ্গল রিভার সার্ভিসের মালিক, তোমার কাছে অনেক লঞ্চ ও বড় বড় বোট আছে। তুমি সুতা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার যানবাহনের মাধ্যমে তাঁতিদের কাছে পৌছাবার ব্যবস্থা করবে। এই কাজে তোমার অনেক লাভ হবে জানি। আমি জানি তুমি মানব দরদী। এই কাজের লাভের টাকা দিয়ে তুমি জনহিতকর কোন কাজ করবে বলে আমি আশা করি। আর. পি. সাহা বললেন, স্যার, আমি আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবো” -[ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীঃ কাছে থেকে দেখা, ৯২ পৃষ্ঠা]।
আর. পি. সাহা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছিলেন। তিনি এই লাভের টাকা দিয়ে মির্জাপুরে তার মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ । এই ট্রস্টের অধীনে পরে প্রতিষ্ঠিত হয় মেয়েদের আবাসিক বিদ্যালয় ভারতেশ্বরী হোমস সহ অনেকগুলো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান।
#
১৯৪৬ সালে দিল্লি সম্মেলনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঐতিহাসিক "পাকিস্তান প্রস্তাব" ভাষণের শেষাংশ,
...আমি এ নিয়ে অনেক চিন্তা করেছি। অনুধাবন করতে চেষ্টাও করেছি যে, মুসলমানরা পাকিস্তান হাসিলের জন্যে লড়তে প্রস্তুত আছে কি । আজ আমি পূর্ণ ঈমানদারী ও সততার সঙ্গে ঘােষণা করছি ঃ বাংলার প্রতিটি মুসলমান আজ লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুত। আমরা পাকিস্তান চাই-এ প্রশ্নের কোনাে অবস্থাতেই আপােষ নেই। এ পথে যেই বাধা দিতে আসবে, মুসলিম জনতাই তাকে সরিয়ে দেবে। পাকিস্তানের জন্যে তারা জান কবুল করতেও প্রস্তুত।
বাঙলা থেকে দিল্লি পর্যন্ত আসার পথে এমন কতগুলাে প্রদেশ অতিক্রম করতে হয়েছে, যে সব এলাকায় মুসলমানরা সংখ্যালঘু। আমি তাদের মধ্যেও আজাদীর প্রাণ-চাঞ্চল্য দেখেছি। তারা আমাকে বলেছেনঃ তোমরা আমাদেরকে আমাদের ভাগ্যের ওপরই ছেড়ে দাও। তবু নিজ এলাকায় তােমরা পাকিস্তান কায়েম করাে। আমাদের ভাইয়েরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করবে, একটি আজাদ দেশের বাসিন্দা হবে এতেই আমাদের গৌরব। সত্য বলতে কি, মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশের মুসলমানরাই আজ আমাদের আজাদীর পথ দেখিয়েছে, আজাদীর পথে উৎসাহ যুগিয়েছে। তাদের এই সুদৃঢ় সংকল্পের প্রতি আমাদের অভিনন্দন। এ তাে গেল সংখ্যালঘু প্রদেশের মুসলমানদের উৎসাহ-উদ্দীপনার কথা। কিন্তু যে সব এলাকায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা পাকিস্তান সংগ্রামে নিজেদের জানমাল সব কিছুই কোরবানী দিতে, সব রকম দুর্যোগ-বিপদ হাসিমুখে বরদাশত করতে আজ প্রস্তুত হয়েছেন। পূর্ণ ঈমানদারি আর সততার সঙ্গেই আজ আমি ঘােষণা করছিঃ বাংলার প্রতিটি মুসলমান আজ প্রস্তুত। আমাদের আজকের একমাত্র দাবি, একমাত্র কাম্য পাকিস্তান। আমাদের পথের প্রতিবন্ধক মুসলিম জনতাই সরিয়ে দেবে। আমরা আজ জান কোরবানে প্রস্তুত।
কায়েদে আজম, আপনি আমাদের পরীক্ষা নিন। আমরা বাংলার মুসলমান পাকিস্তান হাসিলের জন্যে, অভীষ্ট লাভের জন্যে আপনার নির্দেশ মােতাবেক যে কোন ধরনের কোরবানীর জন্যে আজ প্রস্তুত।
দেশরক্ষার ব্যাপারে আমি বলবাে আমেরিকা হােক ব্রিটেনে হােক, কোনাে দেশই তােলার ব্যাপারে আত্মনিয়ােগ করবাে। তবে হিন্দুস্থানের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরােধের এককভাবে আত্মরক্ষায় সমর্থ নয়। তবে একথা আমি বলি না যে, পাকিস্তান লাভের পরই আমরা আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ শুরু করে দেবাে বা অস্ত্র সংগ্রহ ও নিজেদের সশস্ত্র করে ব্যাপারে আমি কেবল একথাই বলতে চাইঃ আমাদের একা ছেড়ে দিন। আমরা নিজেরাই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করে দেবে।
সূত্রঃ গনতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (স্মারক গ্রন্থ), পৃঃ ১২৪
#
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কে জানতে যে বইগুলো পড়তে পারেন-
১. হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীঃ কাছে থেকে দেখা- মাহমুদ নুরুল হুদা
২. গনতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (স্মারক গ্রন্থ)
৩. অসমাপ্ত আত্মজীবনী- শেখ মুজিবুর রহমান
৪. আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর- আবুল মনসুর আহমেদ
৫. ছোটদের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
#
আজ উপমহাদেশের নির্যাতিত মানুষের মহান নেতা এবং আমাদের মাটির রাজনীতির সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের জন্ম বার্ষীকি।
আল্লাহ আপনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নাসিব করুন। আমিন।।
0 Comments