অনল আবেদিন
গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকের কথা। খরা ও আকালের আগুনে, ক্ষুধার জ্বালায় সারা বাংলা জ্বলছে। গ্রামের মানুষের তখন খাদ্য বলতে ছিল ঘাসের বীজ সেদ্ধ, কচু ও সজনের শাক এবং কাচকলার ঝোল, রেশনে পাওয়া ভুট্টার আটা রান্না। অনেকের কাছেই এক মুঠো ভাত ছিল প্রায় দুঃস্বপ্ন। সেই আকালের সময় কলকাতা থেকে তিনি বহরমপুরে এসেছিলেন একটি বামপন্থী দল প্রতিষ্ঠার তাগিদে। তাঁর একটি পায়ের পাতার অধিকাংশটাই কেটে বাদ দেওয়া হয়েছিল কোনও এক কালে। চালচুলোহীন ওই মানুষটি 'মাধববাবু' নামে পরিচিত ছিলেন। পদবিটি সম্ভবত দত্ত, অথবা রায়। আবার অন্য কিছুও হতে পারে। বহরমপুর শহরের সোনাপট্টি এলাকার দৈহাট্টা রোডের স্বর্ণব্যবসায়ী প্রাণগৌর বসাক- সহ অনেকের বাড়ির দাওয়ায়, বা দোকানের ধাপিতে ইটপেতে শুয়ে, অভূক্ত পেটেই অনেক অনেক রাত কেটেছে তাঁর। মাধববাবুর সেই আকালের খবর পৌঁছায় সোনাপট্টি লাগেয়া কাঁসারিপাড়ার ২৯ নম্বর রামসুন্দর মুন্সি লেনের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গুরু আবু দাউদের স্ত্রী দিলরুবা বেগমের কাছে। তারপর থেকে মাধববাবু বহরমপুরে থাকলে ও খাবার না-জুটলে দিলরুবাই ছিলেন তাঁর অকপট আশ্রয়স্থল ও ক্ষুধার সম্বল।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভারতখ্যাত গুরু অরুণ ভাদুড়ি, বহরমপুরের বিখ্যাত তবলিয়া নিত্যগোপাল সাহা, সঙ্গীত শিল্পী দিলীপকুমার ঘোষ ও অনিল সাহা- সহ এমন অনেক সঙ্গীত শিল্পীর পাতে অন্ন তুলে দিয়ে যোহরের নামাজ (দুপুরের) পড়ার জন্য জায়নামাজ বিছাতেন দিলরুবা বেগম। গুরুগৃহে বসবাস করে সঙ্গীত শিক্ষার দুই সাধক--- দিলীপকুমার ঘোষ ও অনিল সাহার ক্ষেত্রে এটি ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। অন্য একটি ঘটনা। ছোটরা তাঁকে 'চিতুদা' বলত। বড়দের তিনি ছিলেন 'চিতু'। পদবিটা সরকার, নাকি দত্ত? আজ আর মনে নেই। বহরমপুরের নিন্মবিত্ত পরিবারের তিনি সন্তান। মাকর্সবাদের মায়াকাজলে মন রাঙিয়ে তিনি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের হাতছানিতে স্কুলবেলায় বাড়ি ছেড়েছিলেন। সোনাপট্টির দৈহাট্ট রোডের দলের জেলা কার্যালয়ই ছিল তাঁর ঘরদোর। ভাঙা কুলোর মতো কমরেডদের ফাইফরমাস খাটার লোক ছিলেন তিনি। অলিখিত 'হোলটাইমার' চিতুর খাবার না জুটলে 'অন্নপূর্ণা' দিলরুবা বেগমের হেঁশেলই ছিল তাঁর শেষ আশ্রয়স্থল। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত অন্তপ্রাণ আবু দাউদ সেই অর্থে ধনী ছিলেন না। গান শেখানোর দক্ষিণাতেই চলে যেত তাঁর ঢিলেঢালা সংসার। স্বামী-স্ত্রীতে কখনওসখনও বিরল ব্যতিক্রমী ঠোকাঠুকি ছাড়া আর্থিক অপ্রতুলতা আবু দাউদের প্রিয় 'রুবি'র পরহিতব্রতে কোনও দিন প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়নি।
অভাব ও দলীয় অবহেলা- সহ নানা কারণে চিতু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তখন তিনি 'সাম্যবাদী' দলটির গলগ্রহ হয়ে ওঠেন। দিলরুবা কিন্তু স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া চিতুর দায় এড়াতে পারেননি। গত শতাব্দীর আশির দশকে কয়েক দফায় তিনি বছর তিরিশের চিতুকে বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে ভরতি করিয়ে, ওসুধ-পথ্য দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। চিতুর প্রায় সমবয়সী ও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী রবীন বিশ্বাস তখনও ঝড় পত্রিকার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেননি, সাংবাদিকতাও শুরু করেননি। অঙ্কন, সঙ্গীত ও দেওয়াল লিখন- সহ শিল্পের বিভিন্ন শাখার সুক্ষ রসবেত্তা রবীন বিশ্বাস ছিলেন আবু দাউদের ছেলে গোলাম নবীর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। বহরমপুরের নিন্মবিত্ত পরিবারের সন্তান রবীন বিশ্বাস ছিলেন প্রবল শ্বাসকষ্টের রোগী। সহজাত গুণে দুর্বলদের আপনজন হয়ে ওঠা দিলরুবা বেগম মাতৃহীন রবীন বিশ্বাসেরও হয়ে উঠলেন মাতৃসম। কবিপত্নী প্রমীলা কাজির মা গিরিবালা সেনগুপ্তের মতো।
তখন দিলরুবার সংসারের পরিচারিকা ছিলেন স্বামী-সন্তানহীন সায়রা বেওয়া নামের এক তরুণী। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত সায়রাকে একদিন বহরমপুর পুরাতন হাসপাতালে (এখন সেটি কোভিড হাসপাতাল) ভরতি করালেন দিলরুবা। বহরমপুর হাসপাতালে তখন কর্মরত ছিলেন কলকাতার চিকিৎসক ডি সেন (দেবব্রত সেন)। তাঁর সেবাধর্মে মোহিত রিক্সাচালক ও মুটেমজুররা ডি সেনকে 'দেবতা সেন' বলতেন। হতদরিদ্র পরিচারিকা সায়রার প্রতি সম্পন্ন গৃহকর্ত্রীর সেবায় যারপরনায় প্রীত হয়ো উঠলেন ডক্টর ডি সেন। দিলরুবার সঙ্গে এক দিন আলাপ পরিচয়ও করলেন তিনি। পরে কলকাতার এসএসকেএম (পিজি) হাসপাতালের চেষ্ট ডিপার্টমেন্টের 'হেড' হয়েছিলেন তিনি। দিলরুবার সেবাগুণের প্রতি এতটাই শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি পাঠিয়েছেন শুনলে পিজিতে ডি সেনের অধীনে চিকিৎসা করাতে আর কোনও কিছুরই প্রয়োজন পড়ত না কোনও অজ্ঞাতকুলশীল রোগীরও।
আবু দাউদ ও দিলরুবা বেগম--- প্রয়াত এই দম্পতির এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে ও এক মেয়ে নিজেদের পছন্দ মতো ভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ে বিয়ে করেন। এ জাতীয় বিয়েতে অনেক ক্ষেত্রে ধর্মান্তরিত করার একটি প্রচেষ্টা চলে। তাঁদের সন্তানেরা যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় নিজেদের পছন্দ মতো বিয়ে করেছেন, তাই তাঁরা স্বামী-স্ত্রীতে তাঁদের সন্তানদের সঙ্গী-সঙ্গিনীকে ধর্মান্তরিত করার কোনও রকম প্রয়াস দেখাননি। আবু দাউদ ও দিলরুবা বেগম মার্কসবাদে, বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে কখনও দীক্ষিত ছিলেন না। দাস ক্যাপিটালও কখনও হাতে নেড়ে দেখেননি। মাও জে দং-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লনেও কখনও শামিল ছিলেন না। তবুও তাঁদের জীবনবোধ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবোধের অনেকটা উপরের স্তরে অধিষ্ঠিত অনন্য এক মানবধর্মের সুরে বাঁধা পড়েছিল। কোন অমোঘ কারণে এটা সম্ভব হয়েছিল? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সাদাত হাসান মান্টো, মীর মেশারফ হোসেন ও আবু সৈয়দ আয়ুবের সাহিত্যকৃতি ছিল তাঁদের জীবনবোধের পাথেয়। অবসর সময়ে দিলরুবা অনিয়মিত নামাজ পড়ার পাশাপাশি অনিয়মিত সাহিত্য পাঠও করতেন। কেবল এই সাহিত্যসম্পদই কি দিলরুবার অনন্য মানবধর্মের ভিত রচনা করেছিল?
দিলরুবার আব্বা রাহাতউদ্দিন শেখ ছিলেন বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, আরবি, উর্দু, সংস্কৃত ও ফারসি মিলিয়ে মোট ৭টি ভাষায় সড়গড়। জন্মভূমিতেই বসবাস করবেন বলে দেশভাগের সময় সরকারি ভাবে 'ডিক্লেয়ারেশন' দিয়ে পূর্বপাকিস্তানের খুলনার কর্মস্থল ছেড়ে রেলের পদস্থ আধিকারিক রাহাতউদ্দিন মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর থানার (অধুনা দৌলতাবাদ) নওদাপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। এই বাড়ির সামনেই আছে গাঁধীবাদী রাহাতউদ্দিনদের বহু প্রাচীন ওয়াক্তিয়া মসজিদ। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় কবি কাজি নজরুল ইসলামের অনিয়মিত সহযোদ্ধা রাহাতউদ্দিন অবসর জীবনে বাড়ির বাগানের জবাফুল দু কানে গুঁজে, কখনও রামপ্রসাদী, কখনও নজরুল রচিত শ্যামাসঙ্গীত উচ্চস্বরে গাইতে গাইতে মসজিদে যেতেন নামাজ পড়তে। তা নিয়ে গ্রামে জন্ম নেওয়া বিরূপ প্রতিক্রিয়া তিনি গাঁয়ে মাখেননি কখনও।
গত শতাব্দীর সাতের দশক। সর্বব্যাপী আকাল চলছে। কলাডাঙা-নওদাপাড়া গ্রামের প্রান্তে, বহরমপুর-ডোমকল রাজ্য সড়কের পাশে, পরিত্যক্ত সরকারি ডাকবাংলোর প্রাঙ্গনে বেশ কয়েক দিন ধরে আশ্রয় নিয়েছেন বিহারের দুমকা জেলা থেকে আসা শতাধিক ক্ষুৎকাতর সাঁওতাল নারী-পুরুষ। এলাকার বনবাদাড়ের পশুপাখি শিকার করে কিছুদিন ক্ষুন্নিবৃত্তি চলল। পরে তাও শেষ। শতকরা ৯৯.৯৯% মুসলমানের গ্রাম নওদাপাড়ায় হঠাৎ রটে গেল 'বিধর্মী সাঁওতালদের দিনমজুরের কাজে নেওয়া যাবে না।' ক্ষুৎকাতর আদিবাসীদের মসিহা হয়ে এগিয়ে এলেন মধ্যজোতের মালিক 'রাহাতবাবু'। এলাকার দশ গ্রামের নারীপুরুষ শ্রদ্ধায় তাঁকে এ নামেই ডাকতেন। 'আল্লার দুনিয়ায় আল্লার পাঠানো কোনও মানুষ অচ্ছুৎ হতে পারে না' বলে ঘোষণা দিয়ে তিনিই প্রথম সাঁওতালদের নিজের খেতে কাজে লাগালেন। অবশেষে বয়কট উঠল। সস্তাশ্রমে ভূস্বামীরা উপকৃত হলেন। মজুরি পাওয়ায় কর্মহীন আদিবাসীরাও খেয়েপরে বাঁচলেন। পরের ঘটনা আরও অভিনব। আরও প্রেরণাদায়ক।
দিলরুবার এক ভাই কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কলকাতার এক মহিলাকে বিয়ে করেন। ঘটনাক্রমে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ ও শরৎচন্দ্র মুখস্থ করা নব বরবধূ ভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের। তাঁরা এবার গ্রামে ফিরলেন। গ্রামসমাজ থেকে দাবি উঠল, "রাহাতবাবুর ছেলের বৌকে ধর্মান্তরিত হতে হবে।" মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মতো সপাটে ব্যাট চালিয়ে রাহাতবাবু বললেন, "আমি খোদা নই। আমি তো কাউকে ধর্ম দিইনি। তাই কারও ধর্ম কেড়ে নেওয়ার অধিকার আমার নেই। আমি পারব না!" এবার দাবি উঠল, "তাহলে অন্তত নামটা প্রতিমা থেকে বদলে ফতেমা করা হোক!" এবার সচিন তেন্দুলকরের শিল্পীত কভার ড্রাইভের মতো রাহাতবাবু বল পাঠালেন বাউন্ডারির বাইরে। তিনি বললেন, "আমি তো নামটা রাখিনি। নামটা দিয়েছেন তার বাবা-মা। নামটা কেড়ে নিলে বৌমার বাবা-মা খুব কষ্ট পাবেন। তাই আমি তার পিতামাতার দেওয়া নামটা কেড়ে নিতে পারব না।"
ওই ঘটনার জেরে, এখন থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে সপরিবারে রাহাতবাবুকে বয়কট করা হয়। রাতের আঁধারে 'একঘরে' হওয়া রাহাতবাবুর গোয়ালঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে জীবন্ত গবাদিপশু পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়। ধোপা-নাপিত-মুদিখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। গ্রামের প্রান্তে একঘর চর্মকারের বসতি ছিল। মৃত গবাদিপশুর চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া ছিল গৃহকর্তা রাজকুমার দাসের জীবিকা। তাঁর স্ত্রী দায়মার কাজ করতেন। অচ্ছুৎ দায়মা এলাকার তাবৎ মুসলমান পরিবারের প্রসূতির নাড়ি কাটতেন। পিপাসার্ত রাহাতবাবু সেই জলঅচল পরিবারে একদিন জল খেলেন। সেই 'অপরাধ'- এ একঘরে রাহাতবাবু গ্রামসমাজের
একাংশপর দ্বারা চরম অপমানিত হলেন। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।
মৃতদেহ সামনে রেখে সমাজপতিরা দাবি তোলেন, "পুত্রবধূকে ধর্মান্তরিত না-করা পর্যন্ত রাহাতবাবুর লাশের দাফন-কাফন করা হবে না।" শুনে আগুন ঝরে পড়ে রাহাতউদ্দিনের স্ত্রী আমিনা বেওয়ার চোখ দিয়ে। স্বামীর মৃতদেহ ছুঁয়ে ধর্মপ্রাণ বিধবার বজ্র নির্ঘোষ, "লাশ এই উঠোনেই পচবে! তবু ধর্ম-ব্যাপারিদের কাছে মাথানত করব না!" মার্কসবাদ ও শরৎ সাহিত্য মুখস্থ করা 'সর্বহারা' দম্পতি নিজেদের সন্তানসন্তদিদের 'উন্নত' শিক্ষাদানের কামনায় শহরে চলে যায়, নাবালক-নাবালিকা ভাইবোনদের ও বিধবা বৃদ্ধ মাকে গ্রামে ফেলে রেখে। গাঁধীবাদী রাহাতবাবুর স্ত্রী, বৃদ্ধা আমিনা তাঁর নাবালক-নাবালিকা সন্তানসন্ততিদের নিয়ে গ্রামেই একঘরে অবস্থায় পড়ে থাকেন। তবুও নিজেদের অর্জিত সহজ ও সুন্দর জীবনবোধ থেকে, ধর্মবোধ থেকে এই গাঁধীবাদী দম্পতিকে আমৃত্যু টলানো যায়নি। এমন মানবতাবাদী বাবা-মায়ের মানবধর্মে দীক্ষিত, সিক্স পাশ দিলরুবার জীবনবোধ তো এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক! আজকের ধর্ম-সংকটের সময়ে এ জাতীয় প্রণম্যদের মানবধর্মের বিস্তার বড়ই প্রয়োজন। আজকের ধর্ম-ব্যবসার দিনে রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ-বিদ্যাসাগর-নেতাজি-নজরুলের আচরিত মানুষের ধর্মের অনুশীলন বড্ড জরুরি।
0 Comments